||গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়||
ভারতবর্ষের
ঋষিরা কিন্তু যে ব্রহ্ম বা আত্মার স্বরূপ উপলিব্ধ করেছেন তিনি a-moral
অর্থাৎ ন্যায়নীতির ঊর্ধ্বে, সুকু এর পারে, ভালোমন্দের বাইরে। আমরা
a-moralকে immoral বলে মনে করি, আমাদের মানবিক দৃিষ্টতে নীতির পারে যা, তা
অনীতি বা দুনর্ীতির সামিল। তাই কৃষ্ণলীলা শুনতে শুনতে মহারাজ পরীক্ষিতের
বিষম খটকা লেগেছিল। শুকদেবের মুখ থেকে রাসলীলার বর্ণনা শুনে চমকে উঠে তিনি
জিজ্ঞাসা করেছিলেন: সে কি! কৃেষ্ণর এ কি জাতীয় আচরণ? পরদারাভিমর্ষণ! ‘কথং
প্রতীপমচরদ্ বিভূঃ?’ এমন ‘প্রতীপ’ বা প্রতিকূল আচরণ তিনি কী করে করলেন?
উত্তরে শুকদেব সর্বভুক অগ্নির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, চৈতন্যের সেই আগুনে
সবই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, কোনো দোষ বা মালিন্য তাকে স্পর্শ করে না।
‘তেজীয়সাং, ন দোষায় বেহ্নঃ সর্বভুজো যথা।’ একটি দৃষ্টান্ত দিয়েও সঙ্গে
সঙ্গে শুকদেব সাবধান করে দিয়েছেন যে যার ভিতর সেআগুন জ্বলেনি, আত্মার নিত্য
নির্মল শিবস্বরূপকে যে উপলিব্ধ করেনি, সে যদি নীলকেণ্ঠর অনুকরণ করে
‘অদ্বিজংবিষং’ অর্থাৎ সমুদ্রমন্থন জাত হলাহল বা বিষ পান করতে যায় তঁার
দেখাদেখি তাহলে ‘মৃত্যুমৃত্যুমুপৈতি সঃ’, মরণশীল সে মরণকেই বরণ করে, কখনো
কোনোদিনই সে মৃত্যুঞ্জয় হতে পারে না।তাই যথেচ্ছাচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গীতা বা ভাগবতের লক্ষ্য নয়। মৃত্যুঞ্জয় হবার যথার্থ পথ দেখানোই এইসব মহাগ্রন্থের একমাত্র লক্ষ্য। গীতায় সর্বলোকের হনন এবং ভাগবতে পরদারাভিমর্ষণ, এই দুটি ক্রোধ ও কামের, দ্বেষ ও রাগের চরম দৃষ্টান্ত কল্পনা করে দেখানো হয়েছে যে ‘শান্তংশিবং অদ্বৈতং’ এই আত্মস্বরূপে কোনো কিছুরই দাগ লাগে না, এমনই শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ তার রূপ, রাগদ্বেষ, কামক্রোধের অতীত।
কিন্তু আত্মার এই পরম মহিমার বর্ণনা শোনা এক কথা, আর তাকে উপলিব্ধ করা অন্য কথা। শেষ অধ্যায়ে অর্জুনকে এইভাবে চমকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীভগবান বিস্তৃতভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিেশ্লষণ করে দেখিয়ে দিচ্ছেন পরম করুণায় যে জগতে সব জিনিস, জ্ঞানই বলো, কর্মই বলো, কর্তাই বলো, বুদ্ধিই বলো, ধৃতিই বলো, সুখই বলো–ত্রিগুণের দ্বারা সব সমাচ্ছন্ন। পৃথিবীতে, স্বর্গে, এমনকি দেবতাদের মধ্যেও এমন কোথাও কিছু নেই যা এই প্রকৃতির তিন গুণের জাল থেকে মুক্ত। আর তিন গুণের পারে না যেতে পারলে আত্মার যে অত্যাশ্চর্য মহিমার বর্ণনা দিয়েছেন তার কোনো উপলিব্ধই কোনোদিন সম্ভব নয়। তা হলে উপায়?
এই উপায়নির্দেশেই গীতার চমৎকারিত্ব ও অনন্যসাধারণ স্বকীয়ত্ব। অর্জুনকে উপলক্ষ্য করে দোগ্ধা গোপালনন্দন এই পরম অমৃতই দান করেছেন জগৎকে, যার তুলনা ত্রিভুবনে মেলে না। স্বভাব বা নিজের প্রকৃতিকে উল্লঙ্ঘন করে কখনো মুক্তিলাভ করা যায় না, এই হল গীতার সবচেয়ে মূল্যবান উদ্ঘোষণ। প্রাকৃতিক ধারা ধরেই মানুষকে প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে, কর্ম করেই কর্মজাল থেকে মুক্ত হবে, এই হল গীতার অভিনব রাজমার্গ মুক্তিলাভের। কিন্তু সে কোন্ কর্ম? স্বভাবনিয়ত কর্ম, সহজ কর্ম (৪৫৪৮)।
গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ‘গীতার কথা’ থেকে
দৈনিক বর্তমান, কলকাতা, রবিবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০, ৮ ফাল্গুন ১৪১৬
Post a Comment