বৈদ্যিক সনাতন ধর্মে যতগুলি শাস্ত্রীয় গ্রন্থ আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে
বিতর্কিত হলো মনু স্মৃতি। এর কারন বিবিধ তবে সারমর্মে বলা যায় তথাকথিত ধর্ম
ব্যাবসায়ী ও যবনদের দ্বারা বিকৃত ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের মত করে
অপব্যাখ্যা সৃষ্টি করাই এর প্রধান কারন। সেই সত্য আমি আমার পরবর্তীতে
প্রতিটি লেখাতে তুলে ধরার চেষ্টা করবো প্রকৃত মনু স্মৃতির আলোকে। আজ আলোচনা
করবো নারী সম্পর্কে মনু স্মৃতির ভাবনা। অনেক অপপ্রচার কথিত আছে যে মনু
ছিলেন নারী বিদ্বেষী এবং বিভিন্ন ভাবে নারীদের হেয় করেছেন। তাহলে আমরা দেখে
নেই কিভাবে মিথ্যা ভণ্ড প্রচারকরা মনু স্মৃতিকে হেয় করেছে।
যদি
আমরা প্রকৃত অবিকৃত মনু স্মৃতি পর্যালোচনা করি তাহলে যে কেউই গর্বের সাথে
বলতে পারবে যে পৃথিবীর অন্য যে কোন ধর্মীয় শাস্ত্রের চাইতে (অবশ্যই বেদের
পরে) মনু স্মৃতিতে নারীকে অধিকতর উঁচু মর্যাদা দিয়েছে। এমনকি আধুনিক যুগে
নারীবাদীদের গ্রন্থগুলোকে পুনঃ সংকলন করার প্রয়োজন পরে যাবে মনু স্মৃতির
সমকক্ষ হওয়ার জন্য।
মনু স্মৃতিতে দ্বের্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে যে নারী সমাজের কল্যানের ভিত্তি গড়ে দেয়।
৩.৫৬ যে সমাজ নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সে সমাজ মর্যাদা ও
সমৃদ্ধি বৃদ্ধি লাভ করবে। এবং যে সমাজ নারীকে এই রূপ উঁচু স্তম্ভমূলে আসন
দেয়নি সে সমাজ যতই উদার ও মহান কর্ম করুক না কেন সে সমাজকে দুঃখ, দূর্দশা ও
ব্যার্থতার সম্মুখীন হতেই হবে।
এটা নারীজাতির জন্য তোষামোদি কোন
বক্তব্য নয়। এটা চিরন্তন সত্য আর এই সত্য তাদের জন্য কঠোর ও ঝাঁঝালো হবে
যারা নারীদের হেয় প্রতিপন্ন করে। কিন্তু যারা মাতৃ শক্তিকে স্তুতি করে, গুন
কীর্তিন করে, পূজা করে তাদের জন্য তা সুমিষ্ট অমৃত। প্রকৃতির এই নিয়ম
প্রতিটি পরিবার, সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, জাতি অথবা পুরো মানব সমাজের জন্য
প্রযোজ্য।
আমাদের প্রচুর ধন সম্পত্তি, শক্তি, সামর্থ থাকা
সত্ত্বেও আমরা দাসে পরিণত হব যদি আমরা মহা ঋষির এই উপদেশকে উপেক্ষা করি।
শত্রুদের আক্রমণের পরে শতাব্দীর পর শতাব্দী তাঁর উপদেশ আমরা অমান্য করেছি
এবং সেজন্য আমাদের অবস্থা মন্দ থেকে মন্দতর হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষে এসে
আমরা বৈদিক বার্তাটিকে গভীর ভাবে চিন্তা করতে শুরু করি এবং সেই কারনে আমরা
অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখতে পারছি। সেজন্য রাজা রাম মোহন রায়, ঈশ্বর
চন্দ্র বিদ্যাসাগর, এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মত সমাজ সংস্কারকদের তাদের
প্রচেষ্টার জন্য আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ ও প্রণাম জানাই।
আজও অনেক
রক্ষণশীল ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোতে নারীদের অর্ধ বুদ্ধিদীপ্ত সম্পন্ন এবং
পুরুষের সম অধিকার পাওয়ার অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে। সেজন্য সে
রাষ্ট্রগুলো নরকের চাইতেও অধিক দূর্দশাগ্রস্থ। অতীতে ইউরোপেও যুগের পর যুগ
নারী সম্পর্কিত হাস্যকর ও ক্ষতিকারক বাইবেলীয় মতবাদ অনুসরণ করেছিল এবং
সেজন্যই পৃথিবীর সব চেয়ে কুসংস্কারপূর্ন স্থান গুলোর মধ্যে ইউরোপ ছিল।
পরবর্তীতে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং কঠোর ভাবে বাইবেলকে থামানো হয় সেজন্য
ধন্যবাদ সংস্কার যুগকে। এর ফল স্বরূপ দ্রুত অগ্রসর হতে পেরেছিল তারা।
কিন্তু এখন নারী বলতে সেই ধরা বাঁধা ভোগের সামগ্রী ইন্দ্রিয় সুখের উপকরণ
হিসেবে দেখা হয় সম্মানপূর্ন মাতৃ শক্তি রূপে দেখা হয় না। এবং সেজন্য বৈষয়িক
বিষয়ে তারা অনেক অধিকতর ও ব্যাপক উন্নতি লাভ করার পরেও পশ্চিমা বিশ্ব আজ
অনিরাপত্তা এবং মনের শান্তির অভাব দ্বারা আক্রান্ত।
আসুন মনু স্মৃতির আরও কিছু শ্লোক পর্যালোচনা করি এবং আমাদের সমাজে সেগুলোকে প্রয়োগ করার উদ্যোগ নেইঃ
বহু বিবাহ হচ্ছে পাপঃ
৯.১০১ স্বামী ও স্ত্রীকে মৃত্যু অবধি এক সঙ্গে থাকা উচিত। তারা অন্য
সঙ্গীর সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা করবে না এবং কোন অসদাচার যৌনাচার করবে
না। সার কথা হচ্ছে এটাই মানব জাতির ধর্ম।
তাই যে সকল সমাজ ও
সম্প্রদায় বহু বিবাহ, যৌনদাসী এবং খন্ড কালীন ( temporary marriage)
বিবাহকে সমর্থন করে তারা দুঃখ দূর্দশায় জর্জরিত হবেই কারন তারা ধর্মের
অন্তঃসার মতবাদকে উপেক্ষা করেছে, অস্বীকার করেছে, অসমর্থন করেছে।
নারীর স্বায়ত্তশাসনের অধিকারঃ
৯.১১ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়, স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনায়, আধ্যাত্মিক ও
ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন, পুষ্টি এবং গৃহের সকল প্রকার ব্যবস্থাপনায় নারীদের
স্বায়ত্তশাসন ও কর্তৃত্ব প্রদান করতে হবে।
এই শ্লোকের মধ্য দিয়ে
একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে যারা মনে করত যে কোন বৈদিক ধর্মকর্ম নারীরা
করতে পারবে না তা্রা সম্পূর্ণ ভুল ও মিথ্যা ধারণা পোষণ কারী। উপরন্তু নারী
পুরুষ উভয়কেই এই ধর্মীয়নুষ্ঠান পালন করতে হবে। তাই যারা দাবী করে অথবা
পরামর্শ দেয় যে নারীদের বেদ অধ্যায়ন ও চর্চা করার অধিকার নেই তারা মনু ও
বেদ বিরোধী। এই ধরনের অন্ধ গোঁড়ারা জাতীর দুঃখ দূর্দশার কারন। তাই আমরা এই
ধরনের মনোভাবকে কখনোই প্রশয় দেব না যা নারীদের হেয় করে।
৯.১২
পুরুষদের দ্বারা ( পিতা, স্বামী, পুত্র) নারীকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখা হলেও
সে সুরক্ষিত নয়। নারীদের আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে বৃথা নিরর্থক। নারীদের
নিরাপত্তা শুধুমাত্র তার নিজের ক্ষমতা এবং মনোভাবের মধ্য দিয়ে আসে।
এই শ্লোকে ব্যাখ্যা করেছে যে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নারীদের গৃহে
বন্দী করে রাখার প্রচেষ্টা বৃথা, অনর্থক এবং অসমর্থন যোগ্য। বরং তার
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে যাতে সে
নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং অসৎ সঙ্গ দ্বারা ভ্রান্ত হওয়াকে (Mislead)
উপেক্ষা বা এড়িয়ে যেতে পারে। তাই ছোট্ট গৃহে নারীকুলকে আবদ্ধ করে রাখার
প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মনু স্মৃতি বিরোধী।
নমস্কার সবাইকে! সত্য সর্বত্র ব্যপীত হোক!
Post a Comment