
শিব
রোমহর্ষণ উত্তরে বললেন, ‘আপনাদের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবৃত্তিতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। বহু বছর আগে দেবর্ষি নারদ তাঁর পিতা ব্রহ্মার নিকট শিবের কথা জানতে চেয়েছিলেন। সেই কথাই আপনাদের বলছি, শুনুন।’
ব্রহ্মার উপাখ্যান
সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মাণ্ডে কিছুই ছিল না। ব্রহ্মাণ্ডেরই অস্তিত্ব ছিল না। ছিলেন শুধু ব্রহ্ম। তিনি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ছিলেন। এই ব্রহ্ম তপ্তও ছিলেন না, শীতলও ছিলেন না। তিনি স্থূল বা সূক্ষ্ম কিছুই ছিলেন না। তাঁর আদি ও অন্তও ছিল না।

ব্রহ্মার জন্ম
ব্রহ্মা ভাবলেন, পদ্মটি খুঁজে দেখলে তিনি হয়তো তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাবেন। তিনি পদ্মের উৎসটির সন্ধান করার সিদ্ধান্ত করলেন। তিনি পদ্মের মৃণাল ধরে নেমে এলেন এবং একশো বছর ধরে এদিক ওদিক ঘুরলেন। কিন্তু পদ্মের উৎসস্থলটি তিনি খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি ভাবলেন, যে কোষে তাঁর জন্ম সেই কোষেই ফিরে যাবেন। কিন্তু আরও একশো বছর ঘোরাঘুরি করেও সেই কোষটি তিনি খুঁজে পেলেন না। শেষে হতাশ হয়ে খোঁজাখুঁজি ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন।
এমন সময় হঠাৎ দৈববাণী হল, ‘ব্রহ্মা, তুমি তপস্যা করো।’
দৈববাণী শুনে ব্রহ্মা বারো বছর তপস্যা করলেন। বারো বছর পর শঙ্খচক্রগদাপদ্ম-ধারী চতুর্ভূজ বিষ্ণু ব্রহ্মার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। ব্রহ্মা তাঁকে চিনতেন না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’ বিষ্ণু সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘পুত্র, ভগবান বিষ্ণু তোমায় সৃষ্টি করেছেন।’
ব্রহ্মা রেগে বললেন, ‘আপনি আমায় পুত্র সম্বোধন করার কে?’
বিষ্ণু বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছো না? আমি বিষ্ণু। আমারই শরীর থেকে তোমার জন্ম।’ কিন্তু ব্রহ্মা তাঁর উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন।
শিবলিঙ্গের উপাখ্যান
ব্রহ্মা ও বিষ্ণু যখন যুদ্ধ করছেন এমন সময় একটি জ্যোতির্ময় লিঙ্গের আবির্ভাব হল। সেই লিঙ্গের আদি বা অন্ত ছিল না।
বিষ্ণু বললেন, ‘হে ব্রহ্মা, যুদ্ধ থামাও। দ্যাখো, একটি তৃতীয় বস্তুর আবির্ভাব ঘটেছে। এই লিঙ্গটি কী? কোথা থেকেই বা এল? এসো, এর আদি ও অন্ত অনুসন্ধান করে দেখি। তুমি রাজহংসের রূপ ধারণ করে উপরে উঠে যাও। আমি বরাহের রূপ ধারণ করে নিচের দিকে যাচ্ছি।’
এই প্রস্তাবে ব্রহ্মা রাজি হলেন। তিনি শ্বেত রাজহংসের রূপ ধরে উপরে উড়ে গেলেন। বিষ্ণু শ্বেতবরাহের রূপ ধরে নিচে নেমে গেলেন। এক হাজার বছর ধরে তাঁরা সেই লিঙ্গের উৎস খুঁজে ফিরলেন, কিন্তু পেলেন না। তখন তাঁরা যেখানে ছিলেন সেখানে ফিরে এসে প্রার্থনা শুরু করলেন। একশো বছর প্রার্থনার পর একটি ওঁ-কার ধ্বনি তাঁদের শ্রুতিগোচর হল এবং এক পঞ্চানন দশভুজ দেবতার আবির্ভাব ঘটল তাঁদের সম্মুখে। ইনিই মহাদেব শিব।
বিষ্ণু বললেন, ‘ব্রহ্মা আর আমি যুদ্ধ করে ভালোই করেছি। সেই জন্যই তো আপনি আবির্ভূত হলেন।’

পঞ্চানন দশভুজ শিব
সৃষ্টিকথা
ব্রহ্মা বসলেন ধ্যানে। তাঁর ধ্যানের বলে একাধিক ঋষির জন্ম হল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কর্দম, দক্ষ ও মারিচী। মারিচীর পুত্র ছিলেন কশ্যপ। দক্ষের ষাট কন্যা ছিল। তাঁদের মধ্যে তেরোজনের বিবাহ হয় কশ্যপের সঙ্গে। কশ্যপ ও এই কন্যাগণের সন্তানেরা হলেন আদিত্য (দেবতা), দৈত্য, দানব, বৃক্ষ, পাখি, সর্প, পর্বত ও সরীসৃপ। এইভাবে জগৎ জনাকীর্ণ হল।
শিবের দেহসঞ্জাত সত্ত্বা রুদ্রের কথা আগেই বলেছি। রুদ্র কৈলাস পর্বতে বাস করতেন। তিনি দক্ষের কন্যা সতীকে বিবাহ করেন।

সতীর দেহত্যাগ
পরে শান্ত হয়ে রুদ্র সকল দেবতার প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। যজ্ঞ সম্পূর্ণ হল। সতী হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকার কন্যারূপে জন্ম নিলেন। তাঁর নাম হল পার্বতী।
(ক্রমশ)
Post a Comment