পরমাপ্রকৃতি জগজ্জননী শ্রীশ্রীবড়মা |
আকাশ - বাতাসে কি এক পেলব শিহরণ সেই দিন। নিসর্গ উদার, তার সবুজ আসরে গাছপালা, পথঘাট, বন-প্রান্তর যেন এক নূতন অতিথি। চারিদিকে, সেই সবুজ মেলা, সেই সবুজ শিহরণ।
খুবই সুন্দর ছিল সেই দিনের পৃথিবী। বিশেষ করে জনসমাজে আজকের মতন তেমন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। লোকসংখ্যা এতো বাড়েনি, নিজভূমে পরবাসীর মত বাস করার কথা কেউ চিন্তায়ও আনেনি। বেশ ছিল এক চলমান, নিরুপদ্রব, নিশ্চিন্ত মানুষের জীবন।
তবে একটা কথা বলার আছে। আজকের মত মানুষ অস্থির না হলেও - উনিশ শতকের প্রথম থেকেই মানুষের জীবনযাত্রা, সমাজ, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনা এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারায় ক্রমশ: অগ্রসর হচ্ছিল। ঈশ্বর বিশ্বাস বিজ্ঞানের প্রভাবে ক্রমশ: ম্লান হয়ে আসছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা নারী ও পুরুষের মধ্যে ধীরে-ধীরে প্রবল হয়ে উঠেছে। নারীর ধর্ম্ম, নারীর কর্তব্য, নারীর শিক্ষা তখন নূতন চেতনায় স্নাত। বলতে গেলে প্রগতিবাদের পথিকাই হল নারী-সমাজ।
পাবনা জেলায় ধোপাদহ গ্রামে এক পন্ডিত ভট্টাচার্য্য পরিবারে শ্রীশ্রীবড়মার জন্ম। পিতা রামগোপাল ও মাতা ত্রিনয়নী দেবী। রামগোপাল তাঁর পিতার মত শাস্ত্রজ্ঞ, সংস্কৃতে পন্ডিত, সিটি কলেজের ছাত্র। তখনকার সমাজ চেতনার তিনিও একজন অংশীদার। বলতে গেলে এই নবজাগরণের শিহরণ তাঁর শিরা্য়-শিরায়। কিন্তু আশ্চর্য, শ্রীশ্রীবড়মার জীবন যেন এই সমাজ-চেতনার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর জন্ম। অর্ন্তমূখীন জীবনের এক সান্দ্র-কল্লোলেরই প্রবাহ সেখানে। মন্দিরকে কেন্দ্র করে পূণ্যার্থী যেমন সাতপাক ঘোরে - শ্রীশ্রীবড়মার জীবনও ছিল তাঁর জীবনটাও শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিয়ে কেন্দায়িত হয়ে উঠেছিল।
শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে তার জীবনেও ছিল কত লোকের পূজা, খ্যাতি, যশ ইত্যাদি। কিন্তু সেদিকে মোটেই দৃকপাত ছিল না তাঁর। ছিল ছায়ার মত অনুসরণ শ্রীশ্রীঠাকুরকে। উমার মত স্বামীতে আত্মস্থ। সেখানে অযুত ঝড়ঝঞ্জা ছিল, তাঁকে বিচু্যত করতে পারেনি। এমন নিবিষ্ট চিত্তের কথা কি লিখবো। বাহ্য প্রকৃতির তবুও আত্মপ্রকাশ আছে - কিন্তু অন্ত:প্রকৃতির সঞ্চরণ যে সেই নিতলে। কার সাধ্য সেই ভাব প্রকাশ করার। লক্ষ-লক্ষ সন্তান আমরা তাঁর - তাঁর স্নেহ, মমতা, শাসন, ভালবাসা আমাদের প্রতি সবই তাঁর কেন্দ্রায়িত জীবনের অভিব্যক্তি। তাই তাঁর স্পর্শ আমাদের কাছে অমন অন্তর ছোঁয়। মা বলে কাছে যেতে জীবন এত নির্বিঘ্ন ধন্য হয়ে ওঠে।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলতেন- আমার এ চরিষ্ণু প্রকৃতির স্থাষ্ণু প্রকৃতি যেন বড় বৌ। তাই তো তিনি মাঝে-মাঝে বলতেন- বড়বৌ না হলে আমার এই জীবন এতো নির্বিঘ্ন হতো না।
শ্রীশ্রীবড়মা সজাগ দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষমান দূরে ঘরের দাওয়ায়। শ্রীশ্রীঠাকুর বাইরে লোক সমাবেশে - কোথায় তাঁর একটু হাঁচি হয়েছে সমস্ত তাঁর লক্ষে্্য্যর মধ্যে । আহারের সময় ধরা পড়ে সেটা, না থাক আজ টক খেয়ে কাজ নেই। হাঁচি হচ্ছে বার বার। এ-হেন অপলক দৃষ্টি শ্রীশ্রীবড়মার। লক্ষ-লক্ষ লোকের আরাধ্য দেবতা শ্রীশ্রীঠাকুর, তাঁরও মূর্ত ভগবান- তাঁকে সেবায় তুষ্ট করবার কি একান্তী সাধনাই না তাঁর।
তাঁর জীবনেই যেন তাঁর নৈবেদ্য। হবেই তো। কতো জায়গা খেকেই শ্রীশ্রীঠাকুরের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু শ্রীশ্রীবড়মার সঙ্গে যেন তাঁর জন্ম-জন্মান্তরের আত্মার আত্মীয়তা, সেখান ছাড়া আর কোথায় এই পবিত্র মিলন হবে? এ-যে তাঁরই নির্ধারিতা পূজারিনী তিনি। শ্রীশ্রীঠাকুরের সত্তারই প্রকৃতি তিনি। তাই তো এই মহামিলন।
কেমন করে বোঝাব শ্রীশ্রীবড়মার কথা? আধুনিক যুগে সমস্ত অস্থিরতা যেন স্তব্দ হয়ে আছে তাঁর মধ্যে। তিনি যেন মহাকালের মহানরূপ। প্রচন্ড ঝড়ের পর যেমন প্রকৃতি শান্ত হয় - আজ এই অস্থিরতার যুগে সেই শান্ত প্রকৃতিরই এক বিশেষ রূপ যেন তিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের আদর্শের ব্যক্তরূপ যেন তিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাবধারা যেমন কালোত্তরণ, তেমনি তাঁর জীবনস্মৃতিও মহাকালেরই স্বর্গ রচনার ভিত। বলতে পারি বর্তমানে - প্রচ্ছন্ন প্রবাহিক, সর্বকালের সর্বজীবনের আদর্শ মাতা। আজ তাঁর জন্মদিন। লক্ষ-লক্ষ সন্তান আমরা তাঁর এই পূণ্য আবির্ভাব দিবসে আসুন প্রণতি জানাই তাঁর শ্রীচরণে। তাঁর শ্রীচরণে আমাদের পূজার নৈবেদ্য সার্থক হয়ে উঠুক।
[ আগামী ৩০শে জুলাই পরমাপ্রকৃতি জগজ্জননী শ্রীশ্রীবড়মা'র শুভ জন্মদিন। জননীর জন্মলগ্নে 'শ্রেয় অন্বেষা ' সকল মা'কে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। মা'কে ভালবাসুন, শ্রদ্ধা করুন, তখনই শ্রীশ্রীঠাকুর খুশি হবেন। ]
Post a Comment