একজন গর্বিত বাবা তার ছেলের ডিগ্রী পেশা ইত্যাদি ইত্যাদি ফলাও করে লিখেছিলেন। আরও লিখেছিলেন - কলকাতা এবং শহরতলিতে বড় বড় ঋত্বিকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা আছে। সম্ভব হলে তাদের সাথে দেখা করে বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়ে যেন পাত্র দেখতে যাই ইত্যাদি। নিজেদের বংশপরিচয় বিবাহাদি ক্রিয়াকর্ম কোনও কিছুই উল্লেখ করেননি। পদবী যা লিখেছিলেন আটঘরের কায়স্থ ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু আটঘরের পদবীগুলি সমস্ত বর্নের মধ্যে আছে। তাই বেশী আলোচনা নিষ্প্রয়োজন মনে করি। পরিশেষে ভদ্রলোক লিখেছিলেন - আপনার মেয়ের যদি ঠিক তেইশ বছর বয়স হয় তবেই অগ্রসর হওয়া যায়। কারন, আমি ঠাকুরের বিধান অনুযায়ী ছেলের বিয়ে দিতে চাই।
উপরোক্ত চিঠির আমি ছোট্ট একটা উত্তর দিয়েছিলাম। আপনি তো শ্রীশ্রীঠাকুরের বিধানানুযায়ী ছেলের বিয়ে দিতে চান। কিন্তু এ কথা তো লেখেননি আপনার বংশের বিবাহাদি চলে কিনা! না আর চিঠি আসে নি।
আবার দ্বিতীয় পাত্রের বাবার চিঠি প্রসঙ্গে আসি - তারা কুলীন কায়স্থ। আমাদের সমবিপরীত বংশ। লিখেছিলেন 'আমার ছেলের বয়স সতের বছর, দশম শ্রেনীতে পড়ে, আমার দুটি মেয়ে, মেয়েরা ছেলের চাইতে ছোট, আমার স্ত্রী অসুস্থ তাই আমি ছেলের বিয়ের জন্য একটি কুলীন পাত্রী খুঁজছি। আপনার যদি অন্য মেয়ে থাকে তবে যোগাযোগ করবেন।'
প্রথমত: আমার মেয়ে তখন এম এস সি পড়ে (বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল)। যার একটি মেয়ে এম এস সি পড়ে, তার অন্য মেয়ে থাকলেও, দশম শ্রেনীতে পড়ুয়া সতেরো বছরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে শুধু কুলীন কায়স্থ বলে? সতেরো বছরের পাত্রের জন্য কমপক্ষে বারো বছরের একটা মেয়ে পুরো একটি সংসারের ভার বহন করবে সংসারের মা অসুস্থ বরসহ তিনটি নাবালক সন্তান। বাবা আবার ভিন প্রদেশের চাকরি করেন। হ্যাঁ এ চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম। লিখেছিলাম সতেরো বছরের ছেলের গলায় বিয়ের নামে ফাঁসির দড়ি ঝোলাতে চাইছেন কেন? আর আপনি লিখেছেন সরকারী চাকরি চাইছেন কেন? আর আপনি লিখেছেন সরকারী চাকরি করেন। তাহ'লে আপনি তো আইনের দিক দিয়েও রেয়াই পাচ্ছেন না। না এ চিঠিরও উত্তর আসেনি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন -
' বিবাহ মানুষের প্রধান
দুইটি কামনাকেই
পরিপূরণ করে; -
তার একটি ঊদ্বর্দ্ধন,
অন্য একটি সুপ্রজনন;
অনুপযুক্ত বিবাহে এই দুটিকেই
খিন্ন করিয়া তোলে;
সাবধান।
বিবাহকে খেলনা ভাবিও না -
যাহাতে তোমার জীবন ও
জনন জড়িত।'
( নারীর নীতি, পৃষ্ঠা ১০৯)
শ্রীশ্রীঠাকুরের আমাদের জীবন চলন, জীবনবোধ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি আমাদের বিবাহবিধি সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সাবধান ক'রে দিয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ বক্তব্যই 'তুমি বা তোমার ' বলে উচ্চারিত হয়েছে। আমি প্রথম দীক্ষাগ্রহনের পর শ্রীশ্রীঠাকুরের গ্রন্থরাজি ও 'আলোচনা প্রসঙ্গে' এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের বিদগ্ধজন এবং অত্যন্ত সাধারন মানুষের সঙ্গে কথোপকথন যা পড়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে তিনি আমাকে জীবনে পালনের জন্যই সব বলেছেন। আমার মনে হত, যারা আগে নিয়েছে, তারা শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা নিয়মনীতি সব জানে এবং মানে। প্রায় প্রতিদিনই সৎসঙ্গ অধিবেশনে আলোচনার সময় একজন ইষ্টভ্রাতা জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মা, ঠাকুরের বিবাহ নীতিটা কি? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম - আপনি কতদিন দীক্ষা নিয়েছেন? শ্রীশ্রীঠাকুরের বিবাহনীতি জানেন না? ভদ্রলোক বললেন, 'ছ বছর'।
একইভাবে অনেক অভিজ্ঞতা হ'ল। ভাবলাম আমাকে জানতে হবে এবং জানাতে হবে। জানবার চেষ্টাও নেই অধিকাংশের। দীক্ষিত - অদীক্ষিত সকলেই প্রাই জানেন, নীচু ঘরে মেয়ে দেওয়া এবং উচুঁ ঘরের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ের ফল খারাপ। কিন্তু প্রতিকারের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয় কেউই। অনেকেই বলেন, শ্রীশ্রীঠাকুর ঠিকই বলেছেন। দিন না একটি সম্বন্ধ। আমি ছত্রিশ বছরে আমার ছেলে মেয়ের বিয়ে ছাড়া চার জোড়া বিয়ে দিতে পেরেছি। যতদূর জানি তারা সবদিক দিয়ে সুখে আছে।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা লিখবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না । সেবার আশ্রমে গিয়েছিলাম। একসময় হঠাৎই পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদাকে ফাঁকা পেয়ে গেলাম। মেয়েকে দেখিয়ে বললাম, দাদা! এই আমার মেয়ে, এম এস সি-তে ভর্তি হয়েছে। কুলীন পাত্রের সম্বন্ধ আসে। কিন্তু নিরামিশাষী শুনলে আর রাজী হয় না। আমার কথা শেষ হল কিনা হল - পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদা বাঁহাত প্রসারিত করে অত্যন্ত তেজের কথা সঙ্গে বললেন, 'আমি বলছি ভালো মেয়ে ভালো বিয়ে হবে। পরমপিতা ঠিক করেই রেখেছেন। ' আবার বললেন, এইটুকু মেয়ের জন্য খুব ভাবনায় পড়েছেন। বিয়ে হলেও তুমি পড়াশুনা চালিয়ে যাবে।
মেয়ের বিয়ে হয়েছে সবদিক দিয়ে সম পালটি ঘরে। তবে শুশুরবাড়ি আমিশাষী এবং অন্য আশ্রমে দীক্ষিত। অবশ্য নিরামিশাষী আমার মেয়ে, তাঁদের ভোজদ্রব্য সবই আন্তরিকতার সঙ্গে রান্না করে এবং পরিবেশন করে। মেয়ের শুশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেওর কারও কাছ থেকেই কোনও রকম বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, কথা বা কাজে। বরং ওঁরা অসংখ্যবার বলেছেন, 'আমরা সবদিক দিযে জিতেছি। ছেলের বিয়ে দিয়ে মেয়ে চেয়েছিলাম তাইই পেয়েছি। ' আমার মেয়ের দিক দিয়েও কোনও ক্ষোভ দু:খ নেই।
অন্য প্রদেশে বিয়ে হয়েছে। স্কুলে শিক্ষকতা করছে। দুটি ছেলে মেয়ে হয়েছে। শুশুর-শাশুড়ী অসুস্থ। সাধারণ সংসারের যা কিছু সব নিয়েই স্বাভাবিকভাবেই চলছে। শুধু নিরামিষের খোঁজে আর আর দিকগুলি অপূর্ণ খেকে যায় তা অবাঞ্চনীয়। বহু পরিবারে দেখেছি বর্ণ, বংশ, পদবি, উপাধি ইত্যাদি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সম্বন্ধে অনেক প্রবীণ-প্রবীণা অবহিত নয়। গুরুত্ব দিতেও রাজি নয়। ফলে বহু বছর ধরে বিয়েতে গোঁজামিল ঢ়ুকে গেছে। তা ছাড়া জাতি ভাঁড়ানো মনোবৃত্তি অনেকের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। একবার কয়েকজনের সাথে আলোচনা হচ্ছিল। তাদের বর্ণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে - মা বললো আমরা 'কায়স্থ'। মায়ের বিবাহিত ছেলে বলল - 'আমরা তাঁতী'।
আর একবার এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক তাঁর ছেলের জন্য একটি পাত্রী সন্ধান করতে বলেছিলেন। আমরা খোঁজখবর করছিলাম। ভদ্রলোক একদিন বললেন, 'আমরা বারুজীবী কিন্তু। ' এ কথা শুনে ভদ্রলোকের অবিবাহিত মেয়েটি বলে উঠল - এমা আমরা কায়স্থ না? নিজেদের বর্ণপরিচয় না জানার ফলে অবশেষে স্বনির্বাচিত মিত্র কায়স্থ স্বামী বেছে নিয়েছে।
পরিশেষে শ্রীশ্রীঠাকুর সেই অমোঘ বাণীটি দিয়ে শেষ করব।
'মেয়েরা যদি উপযুক্ত শ্রেয়-পাত্রে
পাত্রস্থ না হয় -
সশ্রদ্ধ অচ্যুত অনুচর্য্যা-আনতি নিয়ে,
তা'দের প্রকৃতি ও কুলকৃষ্টির
অনুপোষণী তাৎপর্য্যে, -
তাহ'লে ,
মেয়ের মানসিক ও বৈধানিক
অপলাপ তো হবেই,
তা' ছাড়া, প্রসূত জাতকের মধ্যে
মানসিক বিকার ও উন্মত্ততা,
জন্মগত বুদ্ধিবৃদ্ধির দৈন্য,
অপকর্ষ-প্রবণতা, অপক্কমনা, বয়:বৃদ্ধতা
উচ্ছল আধিক্যে আত্মপ্রকাশ
ক'রবেই কি করবে;
আর, ভ্রষ্টা ও নষ্টনারীর বিবাহ-নিবন্ধন
ও প্রতিলোমাদি অবৈধ অসঙ্গত বিবাহে
জাতি, সম্প্রদায় ও রাষ্ট্র
ব্যতিক্রমী সন্ততির আবির্ভাবে
কদাচার, কুসংস্কৃতি ও অপজনন-বাহুল্যে
স্বাস্থ্য, বোধি, আয়ু ও সম্পদহীনতায়
নানারূপ ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশায়
আক্রান্ত হ'য়ে
বিকেন্দ্রিকতায় বিনাশের দিকেই,
অগ্রসর হ'য়ে চলবে;
আবার, লোক বাড়লেও
উপযুক্ত বিবাহ প্রথার প্রবর্ত্তনে
সুপ্রজনন যদি না হয় -
অনুলোম নিয়মতান্ত্রিকতায়,-
কবে দুর্বল-স্নায়ু
ও ক্ষীণ-মস্তিষ্কের সংখ্যাবৃদ্ধিতে
এমনকি,
শ্রমিক ও চমুবাহিনী পাওয়াও
দুস্কর হ'য়ে উঠবে দিন দিন;
আর, এই দুর্দ্বৈবের করাল বিকৃতি
অনতিবিলম্বেই চারিয়ে গিয়ে
কী সাংঙ্ঘাতিক রূপ ধারণ করবে, -
একটু নীরব অপেক্ষায়, ধীর বিবেচনায়
তা' প্রতীয়মান হ'তে দেরী হবে না;
যদি ভাল চাও তো বুঝে চল।'
( বিবাহ বিধায়না, ৩৬)
Post a Comment