পৃথিবীতে আশ্চর্য্য যা কিছু আছে, তার মধ্যে সব থেকে আশ্চর্য্যরে বিষয় হল ঈশ্বরের নরলীলা। জগতের সবকিছুই ধরা যায়, মাপা যায়, বোধে আনা যায়, অন্ততঃ অনুমানও করা যায়। কিন্তু এ বিচিত্র ঐশী লীলা সর্ব্বপ্রকার ধারণা বোধ ও অনুমানের পারে, সমস্ত রকম বিরুদ্ধতার এক অদৃষ্টপূর্ব অথচ চমৎকার অর্থকর সমন্বয়।
ঠাকুর আমার! তোমার কথা যা লিখে শেষ করা যায় না, ভেবেও যার কূল পাই না, তারই কিছু যা আমার জীবনে অকাট্য সত্য হয়ে আছে নিগুড় নিবিড় সার্থকতায়, যা আমার ইহজন্মের ও জন্ম-জন্মান্তরের জীবন পথের পরম পাথেয় আমার সাধ্যমত একত্র সংগ্রহ করে তোমাকেই অঞ্জলি দিলাম।
আমার বাবা শ্রীযুক্ত খগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, জন্ম হয় ১৩৫০ সালে ময়মনসিংহ জেলার পাইকুড়া গ্রামে। জমিদার বাড়ির বাবা হলেন ছোট ছেলে। ছোটবেলাই বাবা নিজের বাবা-মাকে হারান। তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মামার বাড়িতে থেকে অনেক কষ্টে পড়া শেষ করেন। পড়াশোনায় ভালই ছিলেন। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে স্বপ্নে দেখলেন। পরম দয়াল বলছেন, ‘তাড়াতাড়ি আমার দীক্ষা নে।’
আমার বাবার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর থেকে বাবার আর মাছ-মাংস খেতে ভাল লাগত না। তিনি লুকিয়ে ফেলে দিতেন। যার মাছ-মাংস খাওয়া ঘরে জন্ম, কি আশ্চর্য্য এই অদ্ভুত পরিবর্তন তিনি তা নিজেই ভালভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না। তারপর বেশ কয়েকদিন পরে, এক পাল দোকানে ঠাকুরের ছবি দেখতে পেয়ে বাবা দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কে? কোথায় থাকেন? তখন লোকটা বললেন, তিনিতো দয়ালু ঠাকুর, বর্তমানে দেওঘরে থাকেন। বাবা তারপর দয়াল ঠাকুর সন্ধানে দেওঘর যান। দেওঘরে দয়ালের দর্শন পান। ঠাকুরকে দর্শন করে বাবা বললেন, ঠাকুর আমার কেউ নেই, তখন ঠাকুর জোরে বলে ওঠলেন, “ দূর বোকা! যার কেউ নেই, তার আমি আছি, আমার কাজ শ্রেষ্ঠ কাজ। যা ঘুরে ঘুরে আমার কাজ কর।’
বাবা সেদিন থেকে পরম দয়ালের নির্দেশানুসারে কাজ করা শুরু করে দিলেন। ঠাকুরের দয়ার কথা লিখে শেষ করা যায় না। তিনি পরম করুণাময় দীনদয়াল, প্রভু আমার। দুনিয়ার মানবের জন্য যে বিধিবিধান শ্রীশ্রীঠাকুর দান করেছেন তার প্রথম বিষয় হল মানুষকে সৎনামে দীক্ষিত করে তোলা।
এক বছর পরই পরমপূজ্যপাদ বড়দা ঋত্বিকের পাঞ্জা দেন বাবাকে, দয়াল ঠাকুর পাবনায় অবস্থান করার সময় থেকেই দীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করার কথা বলে আসছেন। তিনি দেখেছেন, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিমান করে গড়ে তুলতে হলে মানুষগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী অপূরয়মান আদর্শের ছায়াতলে সমবেত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দীক্ষার ভিতর দিয়েই আসে ইষ্টপুরুষের প্রতি অনুরাগ ও ভালবাসা, আর ভালবাসা প্রিয়কে সবসময় সুস্থ ও আনন্দিত রাখতে চায়। এইভাবেই জীবনটা এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। প্রবৃত্তিগুলি আপনা থেকেই কল্যাণের পথে সুকেন্দ্রিক হতে থাকে। ভক্তপ্রবর হনুমানের অসীম শক্তি। কিন্তু তিনি তা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেননি, করলেন তাঁর প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রক্ষায়, রাবনের বংশ ধ্বংস করার কাজে।
সৎদীক্ষা এইভাবে প্রবৃত্তিগুলোকে সুবিনায়িত করে তোলে। প্রবৃত্তিগুলি যদি সুনিয়ন্ত্রিত না হয় তা’হলে চরিত্র হয়- ঠাকুরের ভাষায় কতগুলি কেউটে সাপের আস্তানা কখন যে বিষাক্ত ছোবল মেরে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে তার ঠিক নেই। কিছু মানুষ কোন এক বিশেষ মতের সমর্থনে একটা দল বাধতে পারে। কিন্তু তার ভিতর দিয়ে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টা না থাকার দরুণ এ দলের মধ্যে অচিরেই বিভেদের বীজ দেখা দেয়। মানুষ পারস্পরিকতা বোধ হারিয়ে ফেলে। ফলে সংহতি ও একতার ধ্বনি লুণ্ঠিত হয়। বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ব্যাপারটা স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করা যায়।
প্রবৃত্তিগুলো যদি সুনিয়ন্ত্রিত হয়, মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে তখনই মানুষ শাস্তি ও স্বস্তি ভোগ করতে পারে, জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা সুখবার্তা খুঁজে পায়। এ জন্য চাই ঈশ্বরাভিমূখীতা। তাই, মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় মানুষ ঈশ্বর, আচার্য্য, সদ্গুরু। যার সঙ্গে নিত্য যোগ রেখে মানুষ চলতে পারে। তিনিই অবতার পুরুষ, গুরু পুরুষোত্তম,্ নররূপী ভগবান। তাঁর অসীম প্রেমের আকর্ষণে তিনি সবাইকে কাছে টানেন, বুকে তুলে নিতে চান প্রতি-প্রত্যেকটি জীবনকে তিনি আগলে ধরে রাখেন তাঁর নিজ হাতে। আর তারই মাধ্যম হল দীক্ষা।
আমাদের পূরাণ শাস্ত্রে একটি চমৎকার কাহিনী আছে। ধ্রুব যখন শ্রীহরির দর্শন লাভ কামনায় অস্থির হয়ে ঘুরে বেরুচ্ছেন, যখন এক শ্রীহরি ছাড়া তাঁর অন্য কোন ধ্যান-জ্ঞান নেই, তখনও কিন্তু শ্রীহরি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দর্শন দিতে পারছেন না, কারণ ধ্রুব’র দীক্ষা বা গুরু গ্রহণ হয়নি। সদ্্ দীক্ষা ছাড়া ভগবান দর্শন হতে পারে না। তাই শ্রীহরি নারদকে ডেকে বললেন, ‘নারদ, তুমি গিয়ে ওকে দীক্ষা দাও, না হলে তো আমি আর পারছি না।’ নারদ এসে দীক্ষা দানের পর ধ্রুব’র শ্রীহরি দর্শন হয়।
আবার দস্যু রতœাকরের বাল্মীকি মুনীতে রূপান্তরের মূলেও কিন্তু আছে এ দীক্ষা। দীক্ষা দিয়ে মরা মরা করতে করতে তাঁর মুখে রাম নাম উচ্চারিত হয়।
দীক্ষা ইষ্টপুরুষের সঙ্গে যোগ সাধন করে, তাঁর প্রীতির জন্য কর্ম করতে করতে তার উপর টান জন্মায়। চিত্ত একমুখী হয়, আসে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রেরণা। বৃহৎ জনগোষ্ঠী যখন এইভাবে কেন্দ্রায়িত হয়ে এক স্বার্থে অন্বিত হয়ে চলে, তখনই আবির্ভূত হয় সংহতি। আর এককেন্দ্রিক সংহত জীবনই শক্তির উৎস।
ঠাকুরকে পেয়ে সত্যিই বাবা জীবনে সবকিছু ফিরে পেলেন। আমার দুভাই আর আমি হলাম। আমি আর আমার মা সবাই ঠাকুরকে মাথায় নিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করতে লাগলাম। বাবা ঠাকুরের কাজে বাইরে বাইরেই বেশী থাকতেন। আমার মা আমাদের তিন ভাইবোনকে অনেক কিছু করে ক্রমে বড় করতে লাগলেন। বাবা বলতেন, যারা ঠাকুরের কাজ করেন, ওদের কখনও কিছুর অভাব হয় না। আর তাই সত্যি আমরা সবকিছুই অনায়াসে পেয়ে যেতাম। ঠাকুর আমাদেরকে নানান পরিস্থিতির সম্মুখীন করে যোগ্য করে তোলেন।
ছোটবেলার এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, বাবা ঠাকুরের কাজে শহরের বাইরে আছেন। এদিকে আসামে আমাদের শহরে বন্যা শুরু হয়েছিল। যাদের অনেক টাকা পয়সা আছে ওরাও খাবার কিনে খেতে পারছে না। কারণ বন্যার ভয়াবহতা এতই যে, কিছুরই হদিস নেই। এদিকে বাবাও বাইরে। মা আমাদেরকে নিয়ে আশ্রম রোডেই একজন সৎসঙ্গীর (ব্যবসায়ী) বাসায় আশ্রয় নেই। আরও অনেক পরিবার ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল যেহেতু ওদের চারতলা বিরাট বাড়ি। তবে চিন্তার বিষয় ছিল খাবার। চিড়া, দুধ, চিনি, মুড়ি এসবই শুধু সাথে আছে। তবে পরম দয়াল সাথে থাকলে কিছুরই ভাবনা নাই। একজন লোক তার ক্ষেতের ফসল, কিছু চাউল, শাক-সবজি সবকিছু নিয়ে খুঁজে খুঁজে এসে আমাদের ঘরে এনে দিয়ে বলছেন, ‘উনি আমার ঋত্বিক দেবতা, যদি দয়া করে গ্রহণ করতেন।’ লোকটিকে আমার বাবা ঠাকুরের সৎনামে দীক্ষিত করেছিলেন। ঠাকুরই যেন লোকটিকে দিয়ে সব খাবার-দাবার আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়-
আহার দেবেন তিনি / ওরে জিভ দিয়েছেন যিনি, / তোরে সৃষ্টি করে / তোরই কাছে আছেন যিনি ঋণী।
প্রভুর দয়াতে সবই সম্ভব। আমরা যারা প্রভুর চরণতলে আশ্রয় পেয়েছি। প্রভুর নির্দেশ মাথায় নিয়ে চললে আমরা যেকোন পরিস্থিতির সম্মুখ অনায়াসেই করতে পারি। কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতি প্রভুর দয়ায় সুন্দর, নির্মল হয়ে যায়। তবে তার জন্য চাই প্রভুর প্রতি অটুট প্রেম, নিবীড় ভালবাসা।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, ছোটবেলায় মাটির ঘর ছিল, উপরে ছিল খড়ের চাল। যদিও এখন প্রভুর দয়াতে দুটো পাকা বাড়ি, গাড়ি সবকিছুই আছে। কিছুরই অভাব নাই। একবার শীতকালে আমরা যখন সবাই মন্দিরে প্রাথনাই ছিলাম। তখন কেউ আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন মন্দিরেরই এক গুরুভাই (শুভনদা) বলছেন, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে ভিড় বাড়তে লাগল, পুলিশও আসল। কিন্তু সবাই আশ্চর্য্য হল, এইভাবে শীতের সময় আগুন লাগলে, কিছুই বাঁচে না। তবে আমাদের ঘরে কিছুই হয়নি আসলে প্রভু যার সহায়, তার কেউ কিছু করতে পারে না। আর সত্যিই তাই হল। উপর থেকে সামান্য খড় ফেলে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ভিতর কোন আগুনই ছিল না।
শুধু ঠাকুর ঘরে টিম টিম করে ঠাকুরের প্রদীপখানি জ্বলছিল। সবাই বুঝতে পারল কেউ সেটা বাইরে থেকে লাগিয়েছিল। তবে কিছুই করতে পারল না। সবাই ভাবল কিভাবে ঘরটা অক্ষত থাকল। প্রভুতো চির-দয়াময়। তার দয়াতেই ত্রিভুবন চলছে। এভাবে ছোটবেলাতে অনেক ভয়ানক পরিস্থিতি অনায়াসেই কাটিয়ে এসেছি।
এরপরে ঘূর্ণিঝড়ে অনেক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমরা অক্ষত ছিলাম, নতুন ঘরে পূজ্যপাদ বড়দার আশীর্বাদে গৃহপ্রবেশের সৎসঙ্গের দিন অলৌকিকভাবে ঠিক সৎসঙ্গের আগ মুহূর্তেই পরিবেশ শান্ত হয়ে আসা এভাবেই নানান কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও আমরা প্রভুর নাম নিয়ে গেছি। আমরা যখনই জীবনে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, তখনই যেন প্রভুকে আরো বেশী কাছে পাই, তাই একজন ভক্ত বলেছিলেন, দুঃখই আমার গর্বের, যার জন্য তোমাকে এত কাছে পেয়েছি।
সেদিনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। আমার বড় ভাই সবে কলেজে উঠেছে, নামকরা কলেজ। শিলচরের ডিসি কলেজ। আমার দাদা মনি ওরা কলেজ থেকে Picnic-এ যাবে, সবাই গেছে Picnic-এ। হঠাৎ ১২টা নাগাদ চিৎকার শুনলাম, আমার দাদামনির সাথে পাশের গলির আরেক ছেলে যার নাম রাজন ভট্টাচার্য্য, বিল্টু ওরাও গেছে। রাজন দা’র বোন চিৎকার করে কাঁদছে, কী হল? আমার ভাই ওরা যে গাড়িতে গেছে সেইটা নাকি ভয়ংকরভাবে accident হয়ে অনেক নীচে পড়ে গেছে। যারা বেঁচে গেছে, ওদের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো। আমি শুনে পাগল পাগল হয়ে দৌড়ে গেলাম খবর নিতে। রাজন দার বাবা দৌড়ে গেলেন খবর নিতে সত্যি কিনা তা জানতে। জেনে আসলেন সত্যিই ওরা সবাই statistics department থেকেই গেছে, সেটা Accident হয়েছে মালিডোরের সামনে। শুনে আমার দিদা বিছানায় ছিলেন নামতে পারেন না, যেহেতু বয়স হয়েছিল। উনিও বিছনা থেকে নেমে ঠাকুর ঘরে আমার সাথে জোরে জোরে কাঁদছিলেন ভাইয়ের প্রাণ ভিক্ষার জন্য। আমিতো ছোট ছিলাম, তবে আমার ঠাকুরের উপর খুব বিশ্বাস ছিল। পূজ্যপাদ বড়দা আমার দাদামনিকে ‘দীর্ঘায়ু হও’ বলে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তাই একটু ব্যাথা পেতে পারে, তবে ওর কিছুই হবে না ভেবে দিদার উপর রাগ হচ্ছিল, ওরা কেন ওমনভাবে কাঁদছে। আমার কাছে মাত্র ১১ টাকা ছিল, তা ঠাকুরের চরণে রেখে Constant ঠাকুরের নাম করতে থাকি কারও সাথে কোনও কথা না বলে। এভাবে নাম করতে করতে হঠাৎ আমার দাদার গলায় শুনতে পেলাম, ‘মা’ বলে ডাকছে। দাদা ঘরে এসেছে পুরো ভালো সুন্দরভাবে। প্রভুর দয়ায় সব সম্ভব। কোনও চিন্তা নেই, আমাদের যারা জীবনে ঠাকুর পেয়েছি। দাদাকে যেন ঠাকুরই এ বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন, দয়াল দয়া করে। Accident হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, সবাই যে গাড়িতে আনন্দ গান করছিল দাদার কি হল, ভালো লাগছিল না, সে নেমে গেল আবার ওর বন্ধুকে নিয়ে। ঠাকুর সবাইকেই বাঁচাতে এসেছেন। আর সেজন্য তাঁর সাথে সৎনামে যুক্ত হতে হয়। নাহলে তাঁর প্রেমময় ডাক শুনতে পাওয়া যায় না। তাইতো ঠাকুর বলেছেন-
‘সৎ দীক্ষা তুই এক্ষুণি নে
ইষ্টেতে রাখ সম্প্রীতি।
মরণ তারণ এ নাম জপে
কাটেই অকাল যমভীতি।।’
সেদিন, ঠাকুরের দয়ায়ই আমরা আমাদের ঘরের প্রদীপকে ফিরে পেয়েছিলাম। ঠাকুর আমাদের মত সবাইকে বাঁচাতে চান, তাই ঘরে ঘরে তাঁর সেই বীজমন্ত্র বা সঞ্জীবনী মন্ত্র বিলাতে এসেছেন দয়াল দয়া করে। সেই সৎনামে মাতালও ভাল কথা বলা শিখে যায়, যে খারাপ সে কখন যে ভাল হয়ে যায়, সেটা কেউই জানে না। আর যারা ভালো, তারা দেবতায় পরিণত হয়ে যায়। পরমদয়াল একবার নিজের মুখে বলেছিলেন, উনি সবাইকে ভগবান বানাতে এসেছেন। সবার মধ্যেই সেই পরম পুরুষই বিদ্যমান। তাঁর থেকেই সবার সৃষ্টি। জীব-জড় কোন কিছুই বাদ যায় না। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। তিনিই বিরাজ করছেন। তিনি জগতের স্বামী। সবাইকে রাঙ্গাতেই এবার সর্বশক্তি নিয়ে ধরাধামে আবির্ভুত হয়েছেন। তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন সবার জন্য এসেছেন। মুসলমানদেরকেও খাঁটি মুসলমান হতে বলেছেন। পরম দয়াল একবার বলেছিলেন-
‘রসুল পূজা করলে তোদের
জাত যাবে তা’ বলল কে?
রসুলও তোদের সেই অবতার
সেটাও তোরা ভুললি যে।’
- শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
এবার সময় এসে গেছে আমরা পরস্পরের সব বিরোধ, দ্বন্দ্ব, রেষারেষি ভুলে তাঁরই জয়গান চারদিকে এক সাথে গেয়ে বেড়াই, যাতে সবাই প্রভুকে ভালবাসে। কেউ ব্যথায় কাতর হয়ে না থাকে। এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতেই এসেছেন তিনি। তাঁকে ভালবেসে আমরা সবাই সুস্থ, সুন্দর জীবনের অধিকারী হই আর বাকী সবাইকেই প্রভুর সাথে যুক্ত করি। তাইতো দয়াল বলেছেন-
‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধর্ম বলে জানিস তাকে।’
শুধু নিজে ভাল থাকলে হবে না, সবাইকে সেই ভাল থাকার পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তবেই শুধুমাত্র পৃথিবী সুন্দর হবে, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে ফুল, পাখির সুন্দর কণ্ঠে গান করবে। বন্দনা করবে তাঁরই। প্রাণে প্রাণে নবজাগরণের সঞ্চার হবে। তাঁর রাতুল চরণে সবাই আশ্রিত হয়ে এই ধরা আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। সব জড়াদ্বন্দ্ব বিনাশ করে প্রেমের ডোরে সবাইকে একই মালায় গেঁথেছেন পরম দয়াল।
তাই গেয়েছেন-
‘সুন্দর দেখিয়া সুন্দর ইহা
সুন্দর করিব সার।’
লেখক:
কর্মরত, এলজি ইলেকট্রনিক্স
ঠাকুর আমার! তোমার কথা যা লিখে শেষ করা যায় না, ভেবেও যার কূল পাই না, তারই কিছু যা আমার জীবনে অকাট্য সত্য হয়ে আছে নিগুড় নিবিড় সার্থকতায়, যা আমার ইহজন্মের ও জন্ম-জন্মান্তরের জীবন পথের পরম পাথেয় আমার সাধ্যমত একত্র সংগ্রহ করে তোমাকেই অঞ্জলি দিলাম।
আমার বাবা শ্রীযুক্ত খগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, জন্ম হয় ১৩৫০ সালে ময়মনসিংহ জেলার পাইকুড়া গ্রামে। জমিদার বাড়ির বাবা হলেন ছোট ছেলে। ছোটবেলাই বাবা নিজের বাবা-মাকে হারান। তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মামার বাড়িতে থেকে অনেক কষ্টে পড়া শেষ করেন। পড়াশোনায় ভালই ছিলেন। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে স্বপ্নে দেখলেন। পরম দয়াল বলছেন, ‘তাড়াতাড়ি আমার দীক্ষা নে।’
আমার বাবার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর থেকে বাবার আর মাছ-মাংস খেতে ভাল লাগত না। তিনি লুকিয়ে ফেলে দিতেন। যার মাছ-মাংস খাওয়া ঘরে জন্ম, কি আশ্চর্য্য এই অদ্ভুত পরিবর্তন তিনি তা নিজেই ভালভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না। তারপর বেশ কয়েকদিন পরে, এক পাল দোকানে ঠাকুরের ছবি দেখতে পেয়ে বাবা দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কে? কোথায় থাকেন? তখন লোকটা বললেন, তিনিতো দয়ালু ঠাকুর, বর্তমানে দেওঘরে থাকেন। বাবা তারপর দয়াল ঠাকুর সন্ধানে দেওঘর যান। দেওঘরে দয়ালের দর্শন পান। ঠাকুরকে দর্শন করে বাবা বললেন, ঠাকুর আমার কেউ নেই, তখন ঠাকুর জোরে বলে ওঠলেন, “ দূর বোকা! যার কেউ নেই, তার আমি আছি, আমার কাজ শ্রেষ্ঠ কাজ। যা ঘুরে ঘুরে আমার কাজ কর।’
বাবা সেদিন থেকে পরম দয়ালের নির্দেশানুসারে কাজ করা শুরু করে দিলেন। ঠাকুরের দয়ার কথা লিখে শেষ করা যায় না। তিনি পরম করুণাময় দীনদয়াল, প্রভু আমার। দুনিয়ার মানবের জন্য যে বিধিবিধান শ্রীশ্রীঠাকুর দান করেছেন তার প্রথম বিষয় হল মানুষকে সৎনামে দীক্ষিত করে তোলা।
এক বছর পরই পরমপূজ্যপাদ বড়দা ঋত্বিকের পাঞ্জা দেন বাবাকে, দয়াল ঠাকুর পাবনায় অবস্থান করার সময় থেকেই দীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করার কথা বলে আসছেন। তিনি দেখেছেন, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিমান করে গড়ে তুলতে হলে মানুষগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী অপূরয়মান আদর্শের ছায়াতলে সমবেত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দীক্ষার ভিতর দিয়েই আসে ইষ্টপুরুষের প্রতি অনুরাগ ও ভালবাসা, আর ভালবাসা প্রিয়কে সবসময় সুস্থ ও আনন্দিত রাখতে চায়। এইভাবেই জীবনটা এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। প্রবৃত্তিগুলি আপনা থেকেই কল্যাণের পথে সুকেন্দ্রিক হতে থাকে। ভক্তপ্রবর হনুমানের অসীম শক্তি। কিন্তু তিনি তা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেননি, করলেন তাঁর প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রক্ষায়, রাবনের বংশ ধ্বংস করার কাজে।
সৎদীক্ষা এইভাবে প্রবৃত্তিগুলোকে সুবিনায়িত করে তোলে। প্রবৃত্তিগুলি যদি সুনিয়ন্ত্রিত না হয় তা’হলে চরিত্র হয়- ঠাকুরের ভাষায় কতগুলি কেউটে সাপের আস্তানা কখন যে বিষাক্ত ছোবল মেরে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে তার ঠিক নেই। কিছু মানুষ কোন এক বিশেষ মতের সমর্থনে একটা দল বাধতে পারে। কিন্তু তার ভিতর দিয়ে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টা না থাকার দরুণ এ দলের মধ্যে অচিরেই বিভেদের বীজ দেখা দেয়। মানুষ পারস্পরিকতা বোধ হারিয়ে ফেলে। ফলে সংহতি ও একতার ধ্বনি লুণ্ঠিত হয়। বর্তমানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ব্যাপারটা স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করা যায়।
প্রবৃত্তিগুলো যদি সুনিয়ন্ত্রিত হয়, মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে তখনই মানুষ শাস্তি ও স্বস্তি ভোগ করতে পারে, জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা সুখবার্তা খুঁজে পায়। এ জন্য চাই ঈশ্বরাভিমূখীতা। তাই, মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় মানুষ ঈশ্বর, আচার্য্য, সদ্গুরু। যার সঙ্গে নিত্য যোগ রেখে মানুষ চলতে পারে। তিনিই অবতার পুরুষ, গুরু পুরুষোত্তম,্ নররূপী ভগবান। তাঁর অসীম প্রেমের আকর্ষণে তিনি সবাইকে কাছে টানেন, বুকে তুলে নিতে চান প্রতি-প্রত্যেকটি জীবনকে তিনি আগলে ধরে রাখেন তাঁর নিজ হাতে। আর তারই মাধ্যম হল দীক্ষা।
আমাদের পূরাণ শাস্ত্রে একটি চমৎকার কাহিনী আছে। ধ্রুব যখন শ্রীহরির দর্শন লাভ কামনায় অস্থির হয়ে ঘুরে বেরুচ্ছেন, যখন এক শ্রীহরি ছাড়া তাঁর অন্য কোন ধ্যান-জ্ঞান নেই, তখনও কিন্তু শ্রীহরি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে দর্শন দিতে পারছেন না, কারণ ধ্রুব’র দীক্ষা বা গুরু গ্রহণ হয়নি। সদ্্ দীক্ষা ছাড়া ভগবান দর্শন হতে পারে না। তাই শ্রীহরি নারদকে ডেকে বললেন, ‘নারদ, তুমি গিয়ে ওকে দীক্ষা দাও, না হলে তো আমি আর পারছি না।’ নারদ এসে দীক্ষা দানের পর ধ্রুব’র শ্রীহরি দর্শন হয়।
আবার দস্যু রতœাকরের বাল্মীকি মুনীতে রূপান্তরের মূলেও কিন্তু আছে এ দীক্ষা। দীক্ষা দিয়ে মরা মরা করতে করতে তাঁর মুখে রাম নাম উচ্চারিত হয়।
দীক্ষা ইষ্টপুরুষের সঙ্গে যোগ সাধন করে, তাঁর প্রীতির জন্য কর্ম করতে করতে তার উপর টান জন্মায়। চিত্ত একমুখী হয়, আসে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রেরণা। বৃহৎ জনগোষ্ঠী যখন এইভাবে কেন্দ্রায়িত হয়ে এক স্বার্থে অন্বিত হয়ে চলে, তখনই আবির্ভূত হয় সংহতি। আর এককেন্দ্রিক সংহত জীবনই শক্তির উৎস।
ঠাকুরকে পেয়ে সত্যিই বাবা জীবনে সবকিছু ফিরে পেলেন। আমার দুভাই আর আমি হলাম। আমি আর আমার মা সবাই ঠাকুরকে মাথায় নিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করতে লাগলাম। বাবা ঠাকুরের কাজে বাইরে বাইরেই বেশী থাকতেন। আমার মা আমাদের তিন ভাইবোনকে অনেক কিছু করে ক্রমে বড় করতে লাগলেন। বাবা বলতেন, যারা ঠাকুরের কাজ করেন, ওদের কখনও কিছুর অভাব হয় না। আর তাই সত্যি আমরা সবকিছুই অনায়াসে পেয়ে যেতাম। ঠাকুর আমাদেরকে নানান পরিস্থিতির সম্মুখীন করে যোগ্য করে তোলেন।
ছোটবেলার এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, বাবা ঠাকুরের কাজে শহরের বাইরে আছেন। এদিকে আসামে আমাদের শহরে বন্যা শুরু হয়েছিল। যাদের অনেক টাকা পয়সা আছে ওরাও খাবার কিনে খেতে পারছে না। কারণ বন্যার ভয়াবহতা এতই যে, কিছুরই হদিস নেই। এদিকে বাবাও বাইরে। মা আমাদেরকে নিয়ে আশ্রম রোডেই একজন সৎসঙ্গীর (ব্যবসায়ী) বাসায় আশ্রয় নেই। আরও অনেক পরিবার ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল যেহেতু ওদের চারতলা বিরাট বাড়ি। তবে চিন্তার বিষয় ছিল খাবার। চিড়া, দুধ, চিনি, মুড়ি এসবই শুধু সাথে আছে। তবে পরম দয়াল সাথে থাকলে কিছুরই ভাবনা নাই। একজন লোক তার ক্ষেতের ফসল, কিছু চাউল, শাক-সবজি সবকিছু নিয়ে খুঁজে খুঁজে এসে আমাদের ঘরে এনে দিয়ে বলছেন, ‘উনি আমার ঋত্বিক দেবতা, যদি দয়া করে গ্রহণ করতেন।’ লোকটিকে আমার বাবা ঠাকুরের সৎনামে দীক্ষিত করেছিলেন। ঠাকুরই যেন লোকটিকে দিয়ে সব খাবার-দাবার আমাদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। একটি গানের কথা মনে পড়ে যায়-
আহার দেবেন তিনি / ওরে জিভ দিয়েছেন যিনি, / তোরে সৃষ্টি করে / তোরই কাছে আছেন যিনি ঋণী।
প্রভুর দয়াতে সবই সম্ভব। আমরা যারা প্রভুর চরণতলে আশ্রয় পেয়েছি। প্রভুর নির্দেশ মাথায় নিয়ে চললে আমরা যেকোন পরিস্থিতির সম্মুখ অনায়াসেই করতে পারি। কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতি প্রভুর দয়ায় সুন্দর, নির্মল হয়ে যায়। তবে তার জন্য চাই প্রভুর প্রতি অটুট প্রেম, নিবীড় ভালবাসা।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, ছোটবেলায় মাটির ঘর ছিল, উপরে ছিল খড়ের চাল। যদিও এখন প্রভুর দয়াতে দুটো পাকা বাড়ি, গাড়ি সবকিছুই আছে। কিছুরই অভাব নাই। একবার শীতকালে আমরা যখন সবাই মন্দিরে প্রাথনাই ছিলাম। তখন কেউ আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তখন মন্দিরেরই এক গুরুভাই (শুভনদা) বলছেন, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে ভিড় বাড়তে লাগল, পুলিশও আসল। কিন্তু সবাই আশ্চর্য্য হল, এইভাবে শীতের সময় আগুন লাগলে, কিছুই বাঁচে না। তবে আমাদের ঘরে কিছুই হয়নি আসলে প্রভু যার সহায়, তার কেউ কিছু করতে পারে না। আর সত্যিই তাই হল। উপর থেকে সামান্য খড় ফেলে দেওয়া হয়েছে। ঘরের ভিতর কোন আগুনই ছিল না।
শুধু ঠাকুর ঘরে টিম টিম করে ঠাকুরের প্রদীপখানি জ্বলছিল। সবাই বুঝতে পারল কেউ সেটা বাইরে থেকে লাগিয়েছিল। তবে কিছুই করতে পারল না। সবাই ভাবল কিভাবে ঘরটা অক্ষত থাকল। প্রভুতো চির-দয়াময়। তার দয়াতেই ত্রিভুবন চলছে। এভাবে ছোটবেলাতে অনেক ভয়ানক পরিস্থিতি অনায়াসেই কাটিয়ে এসেছি।
এরপরে ঘূর্ণিঝড়ে অনেক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমরা অক্ষত ছিলাম, নতুন ঘরে পূজ্যপাদ বড়দার আশীর্বাদে গৃহপ্রবেশের সৎসঙ্গের দিন অলৌকিকভাবে ঠিক সৎসঙ্গের আগ মুহূর্তেই পরিবেশ শান্ত হয়ে আসা এভাবেই নানান কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও আমরা প্রভুর নাম নিয়ে গেছি। আমরা যখনই জীবনে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, তখনই যেন প্রভুকে আরো বেশী কাছে পাই, তাই একজন ভক্ত বলেছিলেন, দুঃখই আমার গর্বের, যার জন্য তোমাকে এত কাছে পেয়েছি।
সেদিনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। আমার বড় ভাই সবে কলেজে উঠেছে, নামকরা কলেজ। শিলচরের ডিসি কলেজ। আমার দাদা মনি ওরা কলেজ থেকে Picnic-এ যাবে, সবাই গেছে Picnic-এ। হঠাৎ ১২টা নাগাদ চিৎকার শুনলাম, আমার দাদামনির সাথে পাশের গলির আরেক ছেলে যার নাম রাজন ভট্টাচার্য্য, বিল্টু ওরাও গেছে। রাজন দা’র বোন চিৎকার করে কাঁদছে, কী হল? আমার ভাই ওরা যে গাড়িতে গেছে সেইটা নাকি ভয়ংকরভাবে accident হয়ে অনেক নীচে পড়ে গেছে। যারা বেঁচে গেছে, ওদের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো। আমি শুনে পাগল পাগল হয়ে দৌড়ে গেলাম খবর নিতে। রাজন দার বাবা দৌড়ে গেলেন খবর নিতে সত্যি কিনা তা জানতে। জেনে আসলেন সত্যিই ওরা সবাই statistics department থেকেই গেছে, সেটা Accident হয়েছে মালিডোরের সামনে। শুনে আমার দিদা বিছানায় ছিলেন নামতে পারেন না, যেহেতু বয়স হয়েছিল। উনিও বিছনা থেকে নেমে ঠাকুর ঘরে আমার সাথে জোরে জোরে কাঁদছিলেন ভাইয়ের প্রাণ ভিক্ষার জন্য। আমিতো ছোট ছিলাম, তবে আমার ঠাকুরের উপর খুব বিশ্বাস ছিল। পূজ্যপাদ বড়দা আমার দাদামনিকে ‘দীর্ঘায়ু হও’ বলে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তাই একটু ব্যাথা পেতে পারে, তবে ওর কিছুই হবে না ভেবে দিদার উপর রাগ হচ্ছিল, ওরা কেন ওমনভাবে কাঁদছে। আমার কাছে মাত্র ১১ টাকা ছিল, তা ঠাকুরের চরণে রেখে Constant ঠাকুরের নাম করতে থাকি কারও সাথে কোনও কথা না বলে। এভাবে নাম করতে করতে হঠাৎ আমার দাদার গলায় শুনতে পেলাম, ‘মা’ বলে ডাকছে। দাদা ঘরে এসেছে পুরো ভালো সুন্দরভাবে। প্রভুর দয়ায় সব সম্ভব। কোনও চিন্তা নেই, আমাদের যারা জীবনে ঠাকুর পেয়েছি। দাদাকে যেন ঠাকুরই এ বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন, দয়াল দয়া করে। Accident হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, সবাই যে গাড়িতে আনন্দ গান করছিল দাদার কি হল, ভালো লাগছিল না, সে নেমে গেল আবার ওর বন্ধুকে নিয়ে। ঠাকুর সবাইকেই বাঁচাতে এসেছেন। আর সেজন্য তাঁর সাথে সৎনামে যুক্ত হতে হয়। নাহলে তাঁর প্রেমময় ডাক শুনতে পাওয়া যায় না। তাইতো ঠাকুর বলেছেন-
‘সৎ দীক্ষা তুই এক্ষুণি নে
ইষ্টেতে রাখ সম্প্রীতি।
মরণ তারণ এ নাম জপে
কাটেই অকাল যমভীতি।।’
সেদিন, ঠাকুরের দয়ায়ই আমরা আমাদের ঘরের প্রদীপকে ফিরে পেয়েছিলাম। ঠাকুর আমাদের মত সবাইকে বাঁচাতে চান, তাই ঘরে ঘরে তাঁর সেই বীজমন্ত্র বা সঞ্জীবনী মন্ত্র বিলাতে এসেছেন দয়াল দয়া করে। সেই সৎনামে মাতালও ভাল কথা বলা শিখে যায়, যে খারাপ সে কখন যে ভাল হয়ে যায়, সেটা কেউই জানে না। আর যারা ভালো, তারা দেবতায় পরিণত হয়ে যায়। পরমদয়াল একবার নিজের মুখে বলেছিলেন, উনি সবাইকে ভগবান বানাতে এসেছেন। সবার মধ্যেই সেই পরম পুরুষই বিদ্যমান। তাঁর থেকেই সবার সৃষ্টি। জীব-জড় কোন কিছুই বাদ যায় না। আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। তিনিই বিরাজ করছেন। তিনি জগতের স্বামী। সবাইকে রাঙ্গাতেই এবার সর্বশক্তি নিয়ে ধরাধামে আবির্ভুত হয়েছেন। তিনি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন সবার জন্য এসেছেন। মুসলমানদেরকেও খাঁটি মুসলমান হতে বলেছেন। পরম দয়াল একবার বলেছিলেন-
‘রসুল পূজা করলে তোদের
জাত যাবে তা’ বলল কে?
রসুলও তোদের সেই অবতার
সেটাও তোরা ভুললি যে।’
- শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র
এবার সময় এসে গেছে আমরা পরস্পরের সব বিরোধ, দ্বন্দ্ব, রেষারেষি ভুলে তাঁরই জয়গান চারদিকে এক সাথে গেয়ে বেড়াই, যাতে সবাই প্রভুকে ভালবাসে। কেউ ব্যথায় কাতর হয়ে না থাকে। এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতেই এসেছেন তিনি। তাঁকে ভালবেসে আমরা সবাই সুস্থ, সুন্দর জীবনের অধিকারী হই আর বাকী সবাইকেই প্রভুর সাথে যুক্ত করি। তাইতো দয়াল বলেছেন-
‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধর্ম বলে জানিস তাকে।’
শুধু নিজে ভাল থাকলে হবে না, সবাইকে সেই ভাল থাকার পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তবেই শুধুমাত্র পৃথিবী সুন্দর হবে, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে ফুল, পাখির সুন্দর কণ্ঠে গান করবে। বন্দনা করবে তাঁরই। প্রাণে প্রাণে নবজাগরণের সঞ্চার হবে। তাঁর রাতুল চরণে সবাই আশ্রিত হয়ে এই ধরা আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। সব জড়াদ্বন্দ্ব বিনাশ করে প্রেমের ডোরে সবাইকে একই মালায় গেঁথেছেন পরম দয়াল।
তাই গেয়েছেন-
‘সুন্দর দেখিয়া সুন্দর ইহা
সুন্দর করিব সার।’
লেখক:
কর্মরত, এলজি ইলেকট্রনিক্স
Post a Comment