শ্রী
শ্রী ঠাকুরের শিক্ষা ও তত্ত্ব
শ্রী শ্রী ঠাকুরের
শিক্ষাতত্ত্ব সম্পর্কে ভাবনা অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর।তাঁর এই চিন্তা আর সকল চিন্তার
মত ধর্ম চিন্তারই অন্তর্গত। শিক্ষা বিষয়ক তাঁর দু একটি ছড়া উদ্বৃতি করা চলে।
·
লেখাপড়ায়
দড় হলেই
শিক্ষা তারে কয় না
অভ্যাস
ব্যবহার সহজ জ্ঞান
নাহলে শিক্ষা হয় না
·
মুখে
জানে ব্যবহারে নাই
সেই শিক্ষা মুখে চাই।
·
অভ্যাস
ব্যবহার ভাল যত
শিক্ষাও তার জানিস তত।
·
ঝোক
না বুঝে শিক্ষা দিলে
পদে পদে কুপল মিলে।
·
শুধু
পড়াতেই হযনাকো পাঠ
হাতে কলমে করা চাই
হাতে
কলমে করবে যত
সত্ত্বায়ও
ফুটবে তেমনি তাই।
·
শিখবে
তুমি যা
তদবেত্ত্বাকে সামনে রেখে
মকস্
করো তা।
·
আধো
কথার সময় হতে
করে করিয়ে যা শিখাবি
সেইটি
হবে মোক্ষম ছেলের
হিসাবে চল, নয পস্তাবি
·
শিক্ষা
দিবি কি?
আচারে
না থাকরে শিক্ষা
কথার ঝিকিমিকি।
·
শিক্ষকের
নাই ইষ্টে টান
কে জাগাবে ছাত্রের প্রাণ?
·
থাকলে
ছাত্রে ইষ্টে টান
তবেই জাগে করার প্রাণ
---------------------উপরে
শিক্ষা সম্পর্কে ঠাকুরের দশাট ছড়া উদ্বৃতি হয়েছে।প্রথমটিতে, তিনি যা বলেছেন, তা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে আর্য্য ঋষিদের মুখে ভাষায় সংক্ষেপে
শুনেছি। বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করে বহু মানুষ পান্ডিত্য অর্জন করতে পারে ঠিকই, কিন্তূ আমাদের
দেশে তেমন মানুষকে ‘জ্ঞানী’ বলা হয় না। আবার বিদ্যার কোন ডিগ্রি না থাকলেও যার আত্মজ্ঞান জন্মেছে, সহজবোধ দেখা দিয়েছে
বহু অভিজ্ঞতা ও হাতে কলমে জানার দ্বারা তিনি জ্ঞানী আখ্যা পেতে পারেন। এ বিষয়ে আমাদের
দেশের এই পুরাতন বক্তব্যটিকে সুন্দর করে বলেছেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্মগ্রন্থ’
গ্রন্থে।সেকানে গুরু শিষ্যকে বলেছেন-“পান্ডিত্য জ্ঞান নহে। যে ঈশ্বর বুঝিয়েছেন, যে
ঈম্বরে জগতে যে সম্মন্ধ তাহা বুঝিয়াছে সে কেবল পন্ডিত নহে, জ্ঞানী।পন্ডিত না হইলেও
সে জ্ঞানী।এই গ্রন্থের আরেক স্থলে তিনি বলেছেন ‘যে লেখাপড়া জানে না তাহাকেই মুর্খ বলিওনা।
আর যে লেখাপড়া করিয়াছে, তাহাকেই জ্ঞানী বলিও না।জ্ঞান পুস্তক পাঠ ছাড়া অন্য উপায়ে অর্জিত
হতে পারে। আমাদের দেষের প্রাচীন স্ত্রীলোকেরা ইহার উত্তম উদাহরণস্থল। তাহারা প্রায়
কেহই লেখাপড়া জানিতেন না, কিন্তু তাহাদের মতো ধার্মিকও পৃথিবীতে বিরল।কিন্তু তাহারা
বই না পড়ুক, মূর্খ ছিলেন না। কথকের মুখে পুরাণাদি শুনে, অতিথি সৎকার করেও আরো নানাভাবে
তারা জ্ঞান লাভ করতেন।
শ্রীমদভগবদগীতায় স্বযং শ্রীভগবান জ্ঞানের কথা বলতে
গিয়ে জানিয়েছেন যে তাই জ্ঞান যাতে জীব সমুদয় ভূতকে, আত্মাকে এবং ঈশ্বরকে দেখিতে পায়-যেমন
“যেন ভূতান্যনোষেন দ্রক্ষাস্যাত্মন্যথো ময়ি।(৪/৩৯)
এই তকথাগুলো জেনে যদি শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রথম
ছড়াটি পড়ি তাহলে দেখবো যে, লেখাপড়ায় ‘দড়’ অর্থাৎ পান্ডিত্য অর্জন করলেই কোন মানুসের
শিক্ষালাভ হয়েছে-একথা তিনি বলতে চাননি।শিক্ষিত হলে তেমন মানুষের অভ্যাসে ব্যবহারে তার
প্রমাণ মিলবে এবং তাঁর থাকবে সহজ জ্ঞান অর্থাৎ শ্রেষ্ঠজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আনুগত্য,
নিষ্ঠা, একটি স্পষ্ট দ্বিধাহীন ন্যায়বোধ, পারস্পরিক প্রীতিবোধ, সহানুভুতি, আন্তরিকতা
ইত্যাদি আর এগুলো দেখা দিলেই তাঁর সহজ জ্ঞান জন্মেছে বলা যাবে। এতগুলি ভালো চরিত্রগত
দিক বিকশিত না হলে শিক্ষার কোন মূল্য নেই তাঁর। শেখবার অভ্যাস ও পড়বার অভ্যাস থেকে
লেখা ও পড়া শক্তি জন্মাতে পারে, কিন্তু সে ব্যাপারে দক্ষ হলেই শিক্ষা হয় না। এই কারনেই
অন্যত্র শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, “লেখাপড়া শিক্সার একটা গৌন জিনিস। মূখ্য জিনিস হল অভ্যাস,
ব্যবহার, ঝোঁক,নিষ্ঠা,নেশা, প্রত্যয়, চরিত্র ও বৈশিস্ট্যানুপাতিক কর্মদক্ষতার স্ফুরন
ও নিয়ন্ত্রন; অর্থাৎ সবদিক থেকে একজন মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হবে।পূর্বে সহজ জ্ঞান
বলতে বুঝেছি শ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ন্যায়বোধ,
মানুষের প্রতি প্রীতি-সহানুভূতি।এখন দেখছি শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন আত্মপ্রত্যয়, নিজ নিজ
বৈশিষ্ট্যানুযায়ী কর্মদক্ষতা ইত্যাদি দিলেই একজন মানুষকে যথার্থ হিসেবে শিক্ষিত করে তুলে।
দ্বিতীয় ছড়ায় শিক্ষার ব্যবহারিক দিক সম্মন্ধে
সচেতন করা হয়েছে।অর্থাৎ শিক্ষণীয় বা জানার বিষয়গুলো জানলেই হবে না শিক্ষিত ব্যক্তির
ব্যবহারে শিক্ষার সুফলগুলি ফুটে ওঠা চাই-অর্থাৎ্ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি,
ন্যায়পরায়নতা, শ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আত্মবিশ্বাস ও কর্মনৈপুণ্য প্রভৃতি, নইলে
তার জীবনে শিক্ষা নিস্ফল। তাই এই অভ্যাস যার যত ভালো, তার শিক্ষাও তত যথার্থ-একথাই
উপ্ত হয়েছে তৃতীয় ছড়াটিতে।
কিন্তু শুধু পড়লেই মানুষের শিক্ষা বা জ্ঞান পূর্ণতা
লাভ করে না।যা পড়বে তা হাতে-কলমে করে দেখবে।হাতে-কলমে পড়ার জিনিস যতই অনুশীলন যাবে,
মানুষের সত্ত্বাতে সেগুলি ততই ফুটে উঠবে। অর্থাৎ শিক্ষাকে সত্ত্বাগত ও জীবনের সঙ্গে
যুক্ত করে নিতে গেলে তার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে অবহিত হতে হবে।পঞ্চম ছড়াটির এটা-ই
বক্তব্য।
পূর্বে যে শ্রীশ্রীঠাকুর “বৈশিস্ট্যানুপাতিক কর্মদক্ষতার
স্ফুরন ও নিয়ন্ত্রন”-এর কথা বলেছেন, তাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে চতুর্থটিতে।প্রত্যেক
মানুসের ঝোঁক বা প্রবণতার দিকে তাকিয়েই তাকে শিক্ষা দিতে হতে হবে-নইলে শিক্ষা চরিত্রগত
বা সত্ত্বাগত হতে পারে না।ষষ্ঠ ছড়াটিতে শিক্ষাগুরুকে বাদ দিয়ে শিক্ষা যে শিক্ষার্থীর
পক্ষে অর্থহীন-এই বিশেষ দিকটিতে জোর দেওযা হয়েছে।শিক্ষা মূর্ত হয়ে উঠে আদর্শে বা আচার্যে্।আচার্যকে
আচরনের মধ্য দিয়ে তিনি জানান।শিক্ষকের আচরন এই ক্ষেত্রে আচার্যেরই মত- তার মধ্যেই শিক্ষা
জীবন্ত হয়ে উঠে।তাই তাকে সর্বদা সম্মানে রেখে তাঁর নির্দেশিত পথে শিক্ষা অর্জন করবে
শিক্ষার্থী।আর শিক্ষক যদি তেমনি না হন, তাঁ আচসনে যদি শিক্ষার দ্যুতি ফুটে না উঠে,
তাহলে তার শিক্ষাদানের হাজারো প্রয়াস পন্ডশ্রম হতে বাধ্য। শিক্ষক জ্ঞানালোকেপ্রদীপ্ত
না হলে শিক্ষার্থীর অজ্ঞানতার অন্ধকার দূরীভূত করতে পারে না। শিক্ষকের যদি ইষ্টের প্রতি
অচ্যুত আকর্ষণ না থাকে, তাহলে তাঁর আচরনেও শিক্ষার প্রকৃত লক্ষণগুলি ফুটে উঠবে না।এই
কারণে ছাত্রদের শিক্ষায় উদ্দীপ্ত কর তুলতে গেলে শিক্ষককেও ইষ্টনিষ্ঠ হতে হবে ন তার
আচরণেও শিক্ষার লক্ষণকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই কথাগুলো ‘জ’ ও ‘ঝ’-এ উদ্ধৃত ছড়ার ইঙ্গিত্
আর ‘ঝ’-এর ছড়াটিতে শিক্ষার্থীকেও যে ইষ্টপ্রাণ হতে হবে-শিক্ষার পূর্বে দীক্ষা নিয়ে
সেই কথাই বলা হয়েছে।হাতে-কলমে শিক্ষার যে কতো
মূল্য এবং তা যে অতি অল্প বয়স থেকে গৃহে থাকাকালীন পারিবরিক শিক্ষাকালে শিশুকে দিতে
হয়-তা জানিয়ে দেওয়া হযেছে ‘ছ’-এর উদ্ধৃত ছড়াটিতে।
কিন্তু
ছড়াতেই নয়, আলোচনা প্রসঙ্গে এর নানা খন্ডেই প্রশ্নোত্তর দিতে গিযে শ্রীশ্রীঠাকুর শিক্ষা
সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন এবং এ বিষয়ে তার শিক্ষা বিষয়ক বহু বাণী সম্বলিত ‘শিক্ষা বিধায়না’
নামক একখানি অতি মূল্যবান গ্রন্থ আছে।আর্যকৃষ্টির প্রতি শ্রীশ্রীঠাকুরের গভীর শ্রদ্ধা
ছিল। প্রাচীন ভারতবর্ষের তপোবনে গুরুদের আশ্রমে তখন শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল শিক্ষার্থীদের।সেখানে
সকল শিক্ষার্থীদের গুরুগৃহে বাস করে ব্রক্ষা চর্যা শ্রমের শিক্ষা নেতে হতো। গুরুর
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে ‘গুরুর’ পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে শিক্ষার্থীকে নিষ্ঠা,
শ্রম, কঠোর সংযম ও ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্জন করতে হতো।ঋষি বা ঋষির মতো
আচার্যের সান্নিধ্যে শিক্ষা সমাপন করে শিক্ষার্থীরা গার্হস্থ জীবনের উপযোগী হতো। এ
শিক্ষা তাদের চরিত্রকে পূর্ণ বিকশিত করে যথার্থ মনুষত্বধনে ধনী করে তুলতো। অনেকখানি
এই কাঠামোকে মনে রেখে শ্রীশ্রীঠাকুর শিক্ষার বিষয়কে যুগপোযোগী করে নিয়েছিলেন এবং পাশ্চত্য
শিক্ষার সঙ্গে লড়াইয়ে আমাদের দেশীয় শিক্ষা যাতে পশ্চাদপদ না হয় তার জন্য দুয়ের মধ্যে
সামঞ্জস্য করে তিনি এমন একটি শিক্ষাদর্শ গড়ে তুলেছিলেন যা কোনো বিশেষ দেশেরই উপযোগী
নয়, তা হবে সকল দেশের পক্ষে গ্রহনীয়।
পুরাতন সৎসঙ্গীদের কাছ থেকে জেনেছি যে, ঠাকুর শিক্ষার
যে আদর্শের কথা বারবার বলতেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন পাবনা জেলার
হিমাইতপুর আশ্রমের ‘তপোবন’ বিদ্যালয়ে।এখানে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার
ছয় বছরের সময় সীমাকে তিনি তিন বছরে সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই ব্যবস্থায় যথেষ্ট
সুফলও পাওয়া যাচ্ছিল। এখানে যুগ প্রয়োজনে বিভিন্ন অথচ পরষ্পর- সাপেক্ষ বিষয়গুরো মেখানোর
ব্যবস্থা ছিলো।এই শিক্ষারই অর্থরূপে আরো নানা শিল্প, কলাকেন্দ্র, নানা কর্মশালা ও বিম্ব
বিজ্ঞান কেন্দ্র ঐ আশ্রমে গড়ে উঠেছিলো। আর এই তপোবন বিদ্যালয়ে ইষ্টপ্রাণ ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দের
নিবিড় ও মধুর সম্পর্কের মধ্য দিয়েই চলতো শিক্ষাদান পদ্ধতির বাস্তব কর্মযজ্ঞ।
(Posted By Deb Munna)
Post a Comment