নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭-১৯৪৫?) বাবা
জানকীনাথ বসু ও মা প্রভাববতী দেবী শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের
১৮৮৮-১৯৬৯ ভক্ত ছিলেন। সুভাষ বসু একবার ঠাকুর দর্শনে পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রমে
আসেন। এর আগে দুইবার তিনি ঠাকুরের দর্শন পান। তৃতীয় দর্শনে তিনি ঠাকুরের
নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করেন। ঠাকুরের আশ্রম ঘুরে নেতজী বললেন- সাধারণত আশ্রম
বলতে লোকে সন্ন্যাসী বা গৃহত্যাগীদের আশ্রমই বোঝে। গৃহী হয়ে পরিবার সহ
আশ্রম জীবন-যাপন করবার দৃষ্টান্ত আপনারাই প্রথম দেখাচ্ছেন। পরিবার পরিজনের
ভার ঘাড়ে করে, দৈন্য অভাব অভিযোগের মধ্য দিয়ে আপনারা এগিয়ে চলেছেন। তাই
আমার মনে হয়, আপনারা একটা বড়
গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন। আপনারা যদি সত্যি সত্যি
এভাবে আশ্রম গড়ে তুলতে পারেন তাহলে আপনারা দেশের কাছে একটা উজ্জ্বল
দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। গৃহী হয়েও আশ্রমজীবন যাপন করা যায় একথা লোকের কাছে
আর অবিশ্বাস্য বলে বোধ হবে না। এরপর নেতাজী ঠাকুরের কাছে এসে প্রণাম করলেন।
তারপর নেতাজী ঠাকুরের কাছে জানতে চান, দেশের প্রকৃত সেবা করতে হলে কোথা
থেকে আরম্ভ করতে হবে? ঠাকুর একটু ভেবে বললেন, আমার কথা হচ্ছে দেশের কাজ
করতে হলে প্রথম মানুষ তৈরির কর্মসূচি নিতে হবে। ভাল মানুষ পেতে হলেই
বিবাহ-সংস্কার আশু প্রয়োজন। আর এটা এমনভাবে করতে হবে যাতে সব বিয়েগুলিই সুসঙ্গত হয়, আর compatible বিয়ে মানেই বিহিত সঙ্গতি। বর্ণ, বংশ,
আয়ু, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সব হিসাব করে দেখে শুনে কজ করতে হয়। বিহিত বিবাহ
হলেই ভাল সন্তানাদি আসে আর তখন তাদেরই দ্বারাই দেশের, দশের সবারই কাজ হয়।
সেইজন্য মানুষ তৈরির ব্যবস্থা আগে করা প্রয়োজন। দাশদা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন
দাশ, ১৮৭০-১৯২৫ যখন আমায় বললেন যে তিনি মানুষ খুজেঁ পাচ্ছেন না যার উপর ভার
দিয়ে তিনি একটু সরে দাড়ঁাতে পারেন তার উত্তরে আমি একথাই বলেছি। আমরা দেখতে
পাই দুই বাঙালি রাজনীতিবিদ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজী সুভাষ বসুর
কাছ থেকে তিনি একই প্রশ্নের মুখোমুখি হন। অর্থাৎ দুই নেতাই ঠাকুর
অনুকূলচন্দ্রকে দেশসেবা বা সমাজসেবার নির্দেশনা দেয়ার জন্য নির্ভরযোগ্য মনে
করছেন। আর অভিন্ন উত্তরের মধ্যে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমাজচিন্তা তথা
রাষ্ট্রচিন্তাও প্রকাশ পেয়েছে স্পষ্টভাবে। কেবল মানুষতৈরির গুরুত্ব স্বীকার
করেই চুপ করে বসে থাকেননি, মানুষতৈরির পদক্ষেপ হিসেবে বিবাহ-সংস্কারের মতো
মৌলিক চিন্তার কথাও তিনি প্রকাশ করেছেন। অনুকূলচন্দ্র যে গভীর ও মৌলিক
চিন্তার অধিকারী ছিলেন, এই একটি জবাব থেকেই তার ধারণা নেওয়া যায়। ঠাকুরের
জবাব শুনে নেতাজী বললেন, মানুষ তৈরীর যে আশু প্রয়োজন তা ভেবেছি, কিন্তু তা
করতে হলে যে বিবাহ-সংস্কার প্রয়োজন তা ভেবে দেখিনি।ৃ এখন ভেবে দেখছি ভাল
সংস্কার-সম্পন্ন শিশু যদি না জন্মায় শুধু শিক্ষা তাদের বিশেষ কি করতে পারে ?
বীজ থেকেই তো গাছ হয়, বীজ ভাল হলেই গাছ ভাল হবে। এটা আপনার কথা শুনে বুঝতে
পারছি। কিন্তু এতো দীর্ঘসময় সাপেক্ষ। নেতাজীর মতো সমাজসংস্কারক ও জাতীয়
নেতার চেয়েও সমাজচিন্তায় অনেক এগিয়ে ছিলেন ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র, একথা বললে
নেতাজীকে ছোট করা হয় না। দুজনের ভাবনার দিক ছিল ভিন্ন। নেতাজী সমাজকাঠামো
বদলের কথা ভেবেছেন, নতুন রাষ্ট্রগঠনের কথা ভেবেছেন এবং তারঁ জন্য কর্মবীরের
ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু অনুকূলচন্দ্র মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা
বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। নেতাজী চেয়েছেন অতিদ্রুত নতুন সমাজ সৃষ্টির,
অনুকূলচন্দ্র চেয়েছেন অন্তরের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন। তার গতি
সঙ্গত কারণেই হবে ধীর ও শান্ত। ঠাকুর তাই বলেন, দীর্ঘ সময় তো নেবেই- আমরা
তো এতদিন পর্যন্ত জাতির বা সমাজের জন্য কিছুই করিনি। বহু গলদ জমে গেছে। সাফ
করতে সময় নেবে বৈকি? কোন ঝযড়ৎঃপঃঁ চৎড়মৎধসসব সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি এ জাতির
সত্যিকার কল্যাণ হবে বলে আমার মনে হয় না। নেতাজী সুভাষ বসুর সঙ্গে
কথোপকথনের মাধ্যমেই আমরা ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমাজচিন্তার পরিচয় লাভ করতে
পারি। তিনি বিহিত বিবাহের মাধ্যমে সমাজের সুস্থতা তৈরির স্বপ্ন দেখেছেন।
তিনি বর্ণ, বংশ, আয়ু ও স্বাস্থ্য দেখে বিয়ের পাত্রপাত্রী ঠিক করার কথা
বলেছেন। বিষয়টি হয়তো বাস্তবে সম্ভবপর হওয়া কঠিন। বর্ণ যদি রঙ হিসেবে
বিবেচনা করা হয়, তাহলে সাদা-সাদা এবং কালো-কালো বিয়ের পক্ষেই যদি অভিমত
ব্যক্ত হয়, তা কি সকল ক্ষেত্রে মেনে চলা সম্ভবপর হবে? আর বর্ণ যদি
সম্প্রদায়গত হয়, তাহলে শিক্ষা, পেশা ও সংস্কৃতি বাদ দিয়ে কেবল সম্প্রদায়
পরিচয়টাকেই মুখ্য মনে হবে। চলমান সমাজে ঘরের বাইরে এসে কাজ করতে হয়। যে
হারে দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে কি আর আয়ুর পরিধি মাপা সম্ভপর হয়? স্বাস্থ্যও
অপরিবর্তনীয় সূচক? এরকম অনেক প্রশ্ন ভক্তের মনে উদয় হতে পারে। কিন্তু তিনি
যে মূলের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাইছেন, সেখানেই অনুকূলচন্দ্রের সমাজচিন্তার
স্বকীয়তা। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাবনা জেলার হিমাইতপুরে সৎসঙ্গ নামে নতুন
এক আন্দোলন শুরু হয়। এটা মূলত সামাজিক আন্দোলন। পাবনা থেকে সৎসঙ্গ
আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও এখন সারা পৃথিবীতে এর বিস্তার ঘটেছে। আন্দোলনকে
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় দুই
হাজারেরও বেশি সৎসঙ্গ কেন্দ্র রয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রকৃত মনুষ্যত্বের
বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়েই শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সৎসঙ্গ
আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। সৎসঙ্গ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের
একটি মিলনক্ষেত্র। একটি জনকল্যাণমূলক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। অনুকূলচন্দ্র তারঁ
মায়ের কাছ থেকেই দীক্ষালাভ করেন এবং পরামর্শে সৎসঙ্গ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
সৎসঙ্গ আন্দোলনের জনক শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১২৯৫ বঙ্গাব্দের, ৩০
ভাদ্র, ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টম্বর পাবনার হিমাইতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তারঁ বাবার নাম শ্রী শিবচন্দ্র চক্রবর্ত্তী এবং মাতার নাম মনোমোহিনী দেবী।
ঠাকুরের পৈত্রিক নিবাস ছিল চাটমোহর উপজেলার গুয়াখাড়া গ্রামে। ঠাকুরের মাতা
ছিলেন বিদূষী মহিলা। ঠাকুরের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে তিনি চারলাইনের একটা
কবিতা লিখে পুত্রকে আশীর্বাদ করেছিলেন: অকূলে পড়িলে দীনহীন জনে নুয়াইও শির,
কহিও কথা। কূল দিতে তারে সেধো প্রাণপণে লক্ষ্য করি তার নাশিও ব্যাথা। এটি
এক্রোসটিক ধরনের কবিতা। প্রথম চরণের প্রথম অক্ষর পাশাপাশি বসালে ঠাকুরের
নাম পাওয়া যায়। কবিতার মধ্যে রয়েছে দর্শনের সন্ধান। অনুকূলচন্দ্র জীবনে এই
আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। তিনি কলিকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল
থেকে ডাক্তারি পাস করে নিজ গ্রামে চিকিৎসা শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন
মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক এ তিন প্রকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। তিনি
মানসিক ব্যাধির চিকিৎসার প্রতিই বেশি জোর দিতেন। মানসিক রোগ নিয়ে গবেষণার
ফলেই সৎসঙ্গের চিন্তা তারঁ মাথায় আসে। সৎসঙ্গী হওয়া মানে জীবন ও বৃদ্ধিকে
লাভ করার জন্য যারা যত্নশীল হওয়া। সৎসঙ্গের দর্শন থেকে ঠাকুর ধর্মকে যেভাবে
সংজ্ঞায়িত করেছেন- * অন্যে বাচঁায় নিজে থাকে ধর্ম বলে জানিস তাকে। * ধর্মে
সবাই বােচঁ বাড়ে সম্প্রদায়টা ধর্ম নারে। অর্থাৎ সৎসঙ্গ দর্শনে ধর্মের কোন
পৃথক প্রকার নির্দিষ্ট করা হয়নি।। শ্রীশ্রী ঠাকুর ধর্মকে জীবনবৃদ্ধির
বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করেছেন। জীবনবৃদ্ধির জন্য তিনি শিক্ষা, কৃষি, শিল্প ও
সুবিবাহের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ চারটি উপাদানকে মানব অস্তিত্বের
মৌল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ চারটি স্তম্ভকে প্রতিপালন করাকে
রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেছেন। এইখানেই অনুকূলচন্দ্রের সমাজচিন্তা
প্রকটিত হয়েছে। সৎসঙ্গী নামের পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় সম্পাদক শাক্য
সিংহসেন লিখেছেন- কেমন করে ভগবান এ বিশ্বসংসার সৃষ্টি করেছেন বা স্বয়ং এ
বিশ্ব সংসাররূপে সৃষ্ট হয়েছেন তা বোঝার জন্য এত বুদ্ধি খরচ নাই বা করা গেল?
দর্শনকারেরা যুক্তি প্রমাণের লাঠির ওপর দিয়ে ফিহাত নানা ভঙ্গিতে
ংড়সবৎংধষঁঃ খেতে খেতে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তারচেয়ে ঢের বেশী জিনিস
এতটুকু ভাগবত প্রেরণাযুক্ত সরল প্রাণের সহজ বিশ্বাস। প-িতের পাহাড় প্রমাণ
শুষ্ক শাস্ত্রজ্ঞানের চেয়ে মুর্খের এতটুকু রসাল বিশ্বাস লক্ষগুণে বেশী
ভারী। সাংখ্যকার ষাট হাজার বছর তপস্যা করে যে দর্শন লাভ করেছিলেন তার ভিতর
হাজার সত্যি কথা থাক- যদি দর্শন না থাকে, অনূভুতি না থাকে তবে তাতে তোমার
আমার কি আসে যায়? শ্রীশাক্য সিংহসেন, বিশে পাগলার চিঠি, শ্রী শাক্যসিংহ সেন
সম্পা সৎসঙ্গী, কোলকাতা: আশ্বিন, ১৩২৭ পৃ ২৮ বোঝা যাচ্ছে, সৎসঙ্গী
পত্রিকার মাধ্যমে সহজ ভাষায় ঠাকুরের বাণী প্রচার করে এই আন্দোলনকে জনপ্রিয়
করে তোলা হয়। এ সময়ে অনেক প-িত সৎসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হন। সৎসঙ্গ মানুষকে
নৈতিক শিক্ষা দানে সদাসক্রিয়। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত হিমাইতপুর
থেকে ঠাকুর সৎসঙ্গের কাজ পরিচালনা করেছিলেন। এ সময়ে গোটা ভারতবর্ষে ঠাকুরের
খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং সৎসঙ্গ আন্দোলন পূর্নতা লাভ করে। জাতীয় পর্যায়ের
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাহাত্মাগান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী
সুভাষ বসু এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি হিমাইতপুর এসে
ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করেন এবং সৎসঙ্গ আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সপরিবারে ঠাকুর মহাশয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং
মৃত্যyর পূর্বে দার্জিলিং যাত্রাকালে কিছুদিনের জন্য আশ্রম বাটিকায় অবস্থান
করেছিলেন। সৎসঙ্গের আদর্শ অনেক কীর্তিমান মুসলিম মনিষীদের মাঝেও প্রভাব
বিস্তার করেছিল। উপমহাদেশের খ্যতনামা রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা ফজলুল হক ১৯৩৬
সালে হিমাইতপুর সৎসঙ্গ আশ্রম পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেছিলেন- বাংলার
স্থানে স্থানে আমি যদ্দুর ঘুরে দেখেছি, তাতে সর্বত্রই অসীম দুর্দশার
অবস্থায় দেখেছি। লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে অর্ধাহারে দিন পার করছে। এমতবস্থায়
আমাদের কর্তব্য দুর্দশাগ্রস্ত যারা তাদের ধরে তোলার চেষ্ঠা করা। সৎসঙ্গে
এসে আমি সেই কর্তব্যেরই উদ্বোধনের প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজ করতে করতে আমরা প্রাণে প্রাণে যা অনুসন্ধান করছি তা
হাতে কলমে আরম্ভ করা হয়েছে এ সৎসঙ্গে। আমি দেখছি সৎসঙ্গের আদর্শ প্রকৃত
মুসলিমেরই আদর্শ। তাই এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, প্রত্যেক মসুলমানের
পক্ষেই সৎসঙ্গের আদর্শে চরিত্র গঠন করা উচিৎ। ড. রবীন্দ্রনাথ সরকার সং
অমৃতেরই সিন্ধুহতে, হিমাইতপুর: সৎসঙ্গ পাবলিশিং হাউস, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ,
ভূমিকা পর্ব ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র তারঁ বাণীতে বলেছেন- ভিটামাটি বাড়ির যেটা
পূর্বপুরুষ করেছে বাস, শ্রদ্ধা ভরে রাখবি তারে ছাড়িসনে তা গেলেও শ্বাস। এই
বাণীতে ফুটে উঠেছে ঠাকুরে মাটির প্রতি প্রেমের কথা, যা দেশপ্রেম তথা শেকড়ের
প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা। ঠাকুরের আরেকটি অমিয় বাণীতে বলা হয়েছে- মানুষ আপন
টাকা পর, যত পারিস মানুষ ধর। অর্থবিত্ত নয়, মানুষের প্রতি ভালবাসা, মানুষের
প্রতি নিবেদিত থাকার শিক্ষাই তিনি দিয়ে গেছেন। মানুষ যে সামাজিক অনুষঙ্গ
তােকঁ ভালবাসার কথাই তারঁ আদর্শের ভিত্তি। শ্রীপ্রফুলস্নকুমার দাস রচিত অখ-
জীবন-দর্শন গ্রন্থে ঠাকুরের যে চিন্তাধারা তুলে ধরা হয়েছে, তা থেকে আমরা
সমাজচিন্তার সারাৎসার গ্রহণ করতে পারি। যাজকের দায়িত্ব হিসেবে তিনি যেসব
কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তারঁ তাৎপর্য হিসেবে তিনি উলেস্নখ করেছেন-
যাজক মানুষের মনে সঞ্চারিত করে দেবে জীবনের একটা নূতন মূল্যবোধ, একটা গভীর
দৃষ্টিভঙ্গি। সমস্ত হীনতা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে মহত্তর জীবনের জন্য একটা
ক্ষুধা আছে। সেই ক্ষুধাকে, সেই আগ্রহে দাউদহনী করে তুলতে হবে ইষ্ট, কৃষ্টি ও
ধর্মের রসঘন আনন্দময় পরিবেশনের ভিতর দিয়ে। তখন সেই আগুন ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাবে
সবখানে।
এইভাবেই হবে মানব সমাজের রূপান্তর। পৃ. ৫৭ লক্ষ করছি যে, তিনি
ব্যক্তির দহনকে সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে খািটঁ সোনায় রূপান্তর করতে
চেয়েছেন। ব্যক্তি-আত্মার মুক্তির মাধ্যমে তিনি সমাজ-আত্মার মুক্তি
প্রত্যাশা করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে কল্পনা করেছেন তিনি
সুনিয়ন্ত্রিত জীবনকে। তারঁ চিন্তা ও বক্তব্য থেকে প্রফুলস্নকুমার দাস
উদ্ধার করেছেন- ব্যক্তিজীবন সুনিয়ন্ত্রিত হলে, সেই ভিত্তির উপর দািড়ঁয়ে
দাম্পত্য জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনও ধীরে-ধীরে
সুবিন্যস্ত হয়ে উঠবে। কারণ, ব্যক্তি সমবায়েই এগুলো গঠিত। পৃ. ৬৮ ঠাকুর
অনুকূলচন্দ্র সমাজ-শাসনের ক্ষেত্রে জনন, শিক্ষা ও জীবিকার প্রতি গুরুত্ব
দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে তিনি বর্ণাশ্রমপ্রথাকে প্রবলভাবে সমর্থন করেছেন।
তারঁ চিন্তায় ছিল- দীক্ষা, শিক্ষা, বিবাহ ও জীবিকাজড়িত বর্ণাশ্রমের যে
সর্বাঙ্গীণ সার্বভৌম বিজ্ঞানসম্মত জীবনদর্শন ও সমাজব্যবস্থা তার মৌলিক
তাৎপর্যকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যুগোপযোগীভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
যুগোপযোগীভাবে প্রয়োগ করতে গেলে তো আর বর্ণাশ্রমপ্রথার সমর্থক থাকা যায় না।
অথচ তিনি বলেছেন, অসহিষ্ণু হয়ে আমরা যদি বর্ণাশ্রমের মূল কাঠামোকে বিদায়
দিই, তাহলে বহু বিচিত্র জটিল জীবনসমস্যার সর্বসমঞ্জসা সমাধানসূত্র হারিয়ে
আমরাও বিধ্বস্ত হব, এবং পথভ্রান্ত পৃথিবীও বঞ্চিত হবে এক সর্বপুরয়মাণ
অভ্রান্ত জীবন-বতের্মর অমৃত অবদান থেকে অখ- জীবন-দর্শন, পৃ. ১২৩।
বর্ণাশ্রমের ব্যাপারে ঠাকুরে এই দ্বিধা আমাদের বোধের অতীত। তিনি হয়তো
বর্ণাশ্রমের কল্যাণময় দিকের বাস্তবায়ন চেয়েছেন। কিন্তু সমাজে ও রাষ্ট্রে
পরিপূরিত হতে পারে একমাত্র বর্ণাশ্রমসম্মত বিধানের প্রবর্ত্তনে অখ-
জীবন-দর্শন, পৃ. ১২৭ -ঠাকুরের এই বক্তব্য যুগোপযোগিতার শর্তকে কিছুটা হলেও
প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে ব্রাহ্মণত্বলাভের পথ সকলের জন্য উন্মুক্ত করে তিনি
বলেছেন, ব্রাহ্মণ্যত্বলাভের পথ চার বর্ণেন প্রত্যেকের জন্যই উন্মুক্ত। আর
তাতেই মানবজীবনের পরম সার্থকতা। ৃএকজন শূদ্র নিষ্ঠানন্দিত ছন্দে
স্বকম্র্মের অনুসরণে যদি ব্রাহ্মণত্ব বা ব্রহ্মজ্ঞত্ব লাভ করে, তাহলে সে
কিন্তু বিপ্রেরও গুরু হতে পারে। অখ- জীবন-দর্শন, পৃ. ১৪৪ ঠাকুর
অনুকূলচন্দ্রের এই চিন্তায় ব্যাপক বিপস্নবাত্মক ধ্বনি শোনা যায়। সৎসঙ্গীদের
মধ্যে প্রথাভাঙ্গার এই রীতি হয়তো মান্য করা হচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্য যদি সেই
ব্রাহ্মণ্যত্বলাভ, তাহলে সামাজিক সাম্যচিন্তার অবকাশ থাকে না। ব্রাহ্মণের
সন্তান শিক্ষা গ্রহণ না করলেও ব্রাহ্মণ পরিচয়ে সামাজিক সম্মান অর্জন করবেন।
আর শূদ্রের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েও স্বজাতির কাছে
সম্মানবঞ্চিত হবেন, এই প্রথা এই সমাজে কতখানি অচল, তা একবার ভেবে দেখা
দরকার। নূতন সমাজ-গঠনে মানুষের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে তিনি নতুন কিছু
চিন্তার অবতারণা করেছেন। ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ প্রভৃতি রাজনৈতিক
মতবাদ সম্পর্কেও তারঁ স্বচ্ছ ধারণা ছিল। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত
হওয়া উচিত সার্বজনীন মানবধর্মের ভিত্তির উপর। একমাত্র ধর্মই পারে
ব্যষ্টিমানব ও সমষ্টিমানবের অখ- সত্তার পোষণ দিতে। ধর্মকে রাজনীতি থেকে
পৃথক করতে চাননি। ধর্মচর্চাকে তিনি রাজনীতির জন্য হুমকি মনে করেননি।
সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের দোষগুণ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। ধর্ম,
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সমন্বিত বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধানও করেছেন তিনি।
সমাজকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রকাঠামো কেমন হবে তারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
রাজনৈতিক দলের কাজ কী হবে, আইনপ্রণেতাদের ভূমিকা কী হবে- এ সকল ব্যাপারেও
তারঁ নিজস্ব ধারণা তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি ধর্মনেতা হিসেবে পরিচিত হলেও
সামাজিক বিষয়াবলিতে তারঁ নির্দেশনা তােকঁ একজন সমাজনেতা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা
দিয়েছেন। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমাজচিন্তা কেবল সৎসঙ্গী কিংবা হিন্দুসমাজের
জন্য তো বটেই, গোটা মানবজাতির জন্যই আদর্শ হিসেবে গণ্য হতে পারে। "
Post a Comment