আমাদের এই দেববন্দিত ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন কালেই অতিন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী ঋষি-বিজ্ঞানীগণ মানব জাতির সামগ্রিক উন্নতিতে সুপ্রজনন বিদ্যার অপরিসীম গুরুত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। সুপ্রজনন বিদ্যার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে জন্মগতভাবেই উন্নত সংস্কারওয়ালা জাতকের আবির্ভাব সম্ভব। এই মহাবৈজ্ঞানিক সত্যটি বহুকাল পূর্বেই ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের বোধ দর্শনে ধরা পড়েছিল। তবে শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতীয় ঋষিগণই নন, সুপ্রজনন বিদ্যা এবং জিনবিদ্যা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বহু মনীষিগণও বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই ক্ষেত্রে মহামতি রাসেল, বার্নার্ডশ, এডওয়ার্ড কারপেন্টার, ফ্রেডরিক হ্যারিসন, জি.এস হল, থমসন রাসকিন, স্যার ফ্রাশিস গাল্টন, চার্লস ডারউইন প্রমুখ মহামানবগণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে মানব-সভ্যতার সত্যিকারের উন্নতির জন্য সমাজে সুপ্রজননকে নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এর জন্য আমাদের মূখ্য ও প্রধানতম কর্তব্য হল, সমাজের মধ্যে বৈধ এবং সুসদৃশ বিবাহ ও আদর্শপ্রাণ সুখী দাম্পত্য জীবনযাপনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা।
বর্নাশ্রম সম্বন্ধে ‘গীতায়’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উক্তি করেছেন-
চাতুর্বর্ন্যং ময়া সৃষ্টং গুনকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।। ৪/১৩
অর্থাৎ বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও।
বর্ণাশ্রমে মানুষকে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে, বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে। এই বর্ণবিভাগ অনুসারে বিপ্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল পূজা-পার্বণ, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, শিক্ষাদান, সমাজে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চা ও উন্নতি-সাধন এবং অপরাপর তিন বর্ণের মানুষকে শিক্ষায়-দীক্ষায় এবং ঈশ্বর প্রেমে ও ভক্তিতে সুসমৃদ্ধ করে তোলা। ক্ষত্রিয়দের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, সুদক্ষভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সমস্ত দিককে বংশপরম্পরায় পরিচালনা করা। বৈশ্যের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব হল, পুরুষানুক্রমে সততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি পরিচালনার দ্বারা দেশের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি আনয়ন করা। শূদ্রদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, কৃষিকার্য্য, পশু পালন ও অন্যান্য তিন বর্ণের মানুষের বিভিন্নভাবে পরিপূরণ ও পরিপোষণ করা। চতুবর্ণের গুণরাজি বংশানুক্রমিকতায় নিখুঁতভাবে বাহিত থাকলে দেশ ও সমাজ, দেবপ্রতীমা সুসন্তানের আগমনে ভরপুর হয়ে উঠবে।
আমাদের সমাজে ঋষি প্রদত্ত বিবাহ বিজ্ঞান অনুযায়ী শাস্ত্রে প্রধানতঃ দুই ধরনের বিবাহের অনুমোদন রয়েছে-
প্রথমতঃ সবর্ণবিবাহ, অর্থাৎ বিপ্রের সঙ্গে বিপ্রের, বৈষ্যের সঙ্গে বৈষ্যের, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের এবং শূদ্রের সঙ্গে শূদ্রের বিবাহ হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ অনুলোম অসবর্ণবিবাহ, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় মেয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয় বা বিপ্রের ছেলের এবং শূদ্র মেয়ের সঙ্গে বিপ্র বা বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় ছেলের বিবাহ হতে পারে। তবে এই ধরনের বিবাহজাত সন্তান যদি ছেলে হয় তবে তাকে অবশ্যই মায়ের সমবর্ণের মেয়ের সঙ্গে অথবা তদপেক্ষা নিম্নবর্ণের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। আর যদি অনুলোম অসবর্ণ বিবাহজাত সন্তান মেয়ে হয় তবে ঐ মেয়ের সঙ্গে অবশ্যই তার পিতৃবর্ণের অথবা তদপেক্ষা উদবর্ধিত বর্ণের ছেলের বিবাহ দিতে হবে।
উপরিউক্ত দু’ধরনের বিবাহের ক্ষেত্রেই শাস্ত্রানুমোদিত কয়েকটি বিশেষ ধরনের মানবগুচ্ছ ছাড়া সবক্ষেত্রেই স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। এগুলি ছাড়াও শাস্ত্রে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের বয়স, বংশ, গোত্র, মেধা-শিক্ষা, আয়ু, স্বাস্থ্য ইত্যাদি আরও বিভিন্ন সূক্ষè সূক্ষè বিষয় গভীরভাবে বিবেচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্দেশিকার উল্লেখ রয়েছে। সুসদৃশ বিবাহের জন্য এই সকল নীতি বিধির সুষ্ঠুভাবে পরিচালন করা জাতির প্রত্যেকের পক্ষেই বিশেষ পালনীয় কর্তব্য। আর তাই পরম প্রেমময় শ্রীশ্রী ঠাকুর বলেছেন,
সবর্ণে সগোত্রে বিয়ে দিসনে কোন দিন ভুলে,
করবে বংশ জরাজীর্ণ অসংবদ্ধ সগুণ বহুলে।।
বিশ্ববরেণ্য স্বামী বিবেকানন্দের চতুর্বর্ণ সম্পর্কে এবং এ ছাঁচে বৈদেশিক প্রণালীতে দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মনীষীগণ আর্য্য সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান এই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে দৃঢ়চিত্তে সুপ্রজননের এক মূল্যবান চাবিকাঠি রূপে অবিহিত করেছেন।
পরমপিতা, যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বর্ণাশ্রম সম্পর্কে কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের উল্লেখ করছি।
‘‘শূদ্রইতো জাতির চাকা,
বৈশ্য যোগায় দেশের টাকা,
ক্ষত্রিয়েরা রাজার জাত
সবার পূরন বিপ্র ধাত।’’
সুপ্রজননের প্রধান ভিত্তিই হল বর্ণাশ্রমানুগ সুসদৃশ্য বিবাহ এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রী ঠাকুরের কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি।
‘‘-----সাবধান বিবাহকে খেলনা ভাবিওনা, যাহাতে তোমার জীবন ও জনন জড়িত।’’ ভক্তদের সঙ্গে কথা বললেন- ‘‘বিয়ের গোলমালের ভিতর দিয়ে বহু পাপ, বহু অপরাধ সমাজে ঢুকে গেছে ও যাচ্ছে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বিবাহ সুনিয়ন্ত্রিত করা, যার ফলে কুজনন তিরোহিত হয়ে সমাজে সুস্থ দেহ মনওয়ালা জাতকের সংখ্যা বেড়ে যায়।’’
এ জন্যই শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বর্তমানে মানুষের উন্নতির মূল ভিত্তি বর্ণাশ্রমানুগ বৈধ বিবাহ এবং স্বামী-স্ত্রীর আদর্শপ্রাণ প্রেম ভালবাসাপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি তাঁর ‘নারীর পথে’ গ্রন্থের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন-
‘‘মানুষের মনে জ্ঞান ও অজ্ঞান দুইয়েরই সমাবেশ থাকে। জ্ঞানে উৎকর্ষ, অজ্ঞানে অপকর্ম। মানুষ সাধারণতঃ অজ্ঞানবশতঃ নিকৃষ্টকে সাময়িকভাবে তাহার জীবন ও বৃদ্ধির অনুকূল বলে গ্রহণ করে অশেষ ব্যর্থতা এবং অবসাদে জীবন নষ্ট করতে চাইতে পারে এবং সে ভ্রান্তির ফলেরও আবার একটা পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ক্রমাগতি আছে। তাহলে যা জীবনকে এমনতরভাবে বিব্রত করে মৃত্যুর দিকে চালিত করে। এমন পাপ যাতে সমাজকে বিক্ষুব্ধ করতে না পারে। সে জন্য ঋষিরা বিবাহে বর্ণ, বংশ, বিদ্যা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা ইত্যাদি বিচার করে কন্যার পুরুষকে বরণ করার বিধান দিয়েছেন।’’
তবে পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানকালে বহু অভিভাবকরাও বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রী নির্বাচনে বর্ণ, বংশ, আদর্শ, কুলকৃষ্টি, স্বাস্থ্য, বয়স, শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে ঋষি প্রদত্ত বিবাহ বিজ্ঞানানুসারে বিবেচনা করেন না। বরং তারা বাহ্যিক চাকচিক্য এবং আর্থিক অবস্থাকেই ছেলে, মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সমাজের প্রতিটি মানুষকে আর্য ঋষি বিজ্ঞানীদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমভিত্তিক বিবাহবিধি প্রজনন বিদ্যার নীতি সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন করে তুলতেই হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সুপ্রজননের জন্য প্রথমে বর্ণাশ্রমানুগ শাস্ত্র সম্মত বৈধ বিবাহ এবং পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালবাসার নিরবিচ্ছিন্নতা অবশ্যই চাই। এই রূপ বিবাহে যে সন্তান পাওয়া যাবে তারা খুবই সুস্থ সবল ও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন হবে। তাদের জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তিই থাকবে সততা ও আদর্শপ্রাণতা। প্রতিকূল পরিবেশের প্রচন্ড প্রভাবে এরা যদি কখনও জীবনে বিপথগামী হয়ও, তবে অনুকূল পরিবেশে পড়লেই আবার অতি সহজেই তাদের মধ্যে সুপ্ত সদ্গুণগুলির বিকাশ ঘটবে। আর তাই পরম দয়াল শ্রীশ্রী ঠাকুরের কয়েকটি বাণীর উল্লেখ করে লেখার যবনিকা টানছি।
‘‘মেয়ে বরে বরণ করে, সেই বিয়েতেই সমাজ বাড়ে’’ / ‘‘উন্নত আর সুপ্রজনন এইতো বিয়ের মূল, যেমন তেমন বিয়ে করে করিস নাকো ভুল’’ / পুরুষের বিয়ে উচ্চ ঘরে, বাড়ে আপদ বংশ মারে, পুরুষের বিয়ে নিম্নঘরে উন্নতিতে সমাজ বাড়ে।’’ / ‘‘যে ভাবেতে স্বামী-স্ত্রী করবে উদ্দীপিত, সেই রকমই ছেলে পাবে তেমনি সজ্জীবিত’’ / অভ্যাস ব্যবহার যেমনতর সন্তান ও পাবি তেমনতর’’।
লেখক:
সভাপতি, সিলেট জেলা সৎসঙ্গ
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
বর্নাশ্রম সম্বন্ধে ‘গীতায়’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উক্তি করেছেন-
চাতুর্বর্ন্যং ময়া সৃষ্টং গুনকর্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।। ৪/১৩
অর্থাৎ বর্ণচতুষ্টয় গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি উহার সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে অকর্তা ও বিকাররহিত বলিয়াই জানিও।
বর্ণাশ্রমে মানুষকে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে, বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত করা হয়েছে। এই বর্ণবিভাগ অনুসারে বিপ্রদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল পূজা-পার্বণ, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, শিক্ষাদান, সমাজে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চা ও উন্নতি-সাধন এবং অপরাপর তিন বর্ণের মানুষকে শিক্ষায়-দীক্ষায় এবং ঈশ্বর প্রেমে ও ভক্তিতে সুসমৃদ্ধ করে তোলা। ক্ষত্রিয়দের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, সুদক্ষভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সমস্ত দিককে বংশপরম্পরায় পরিচালনা করা। বৈশ্যের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব হল, পুরুষানুক্রমে সততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি পরিচালনার দ্বারা দেশের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি আনয়ন করা। শূদ্রদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, কৃষিকার্য্য, পশু পালন ও অন্যান্য তিন বর্ণের মানুষের বিভিন্নভাবে পরিপূরণ ও পরিপোষণ করা। চতুবর্ণের গুণরাজি বংশানুক্রমিকতায় নিখুঁতভাবে বাহিত থাকলে দেশ ও সমাজ, দেবপ্রতীমা সুসন্তানের আগমনে ভরপুর হয়ে উঠবে।
আমাদের সমাজে ঋষি প্রদত্ত বিবাহ বিজ্ঞান অনুযায়ী শাস্ত্রে প্রধানতঃ দুই ধরনের বিবাহের অনুমোদন রয়েছে-
প্রথমতঃ সবর্ণবিবাহ, অর্থাৎ বিপ্রের সঙ্গে বিপ্রের, বৈষ্যের সঙ্গে বৈষ্যের, ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের এবং শূদ্রের সঙ্গে শূদ্রের বিবাহ হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ অনুলোম অসবর্ণবিবাহ, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় মেয়ের সঙ্গে ক্ষত্রিয় বা বিপ্রের ছেলের এবং শূদ্র মেয়ের সঙ্গে বিপ্র বা বৈশ্য বা ক্ষত্রিয় ছেলের বিবাহ হতে পারে। তবে এই ধরনের বিবাহজাত সন্তান যদি ছেলে হয় তবে তাকে অবশ্যই মায়ের সমবর্ণের মেয়ের সঙ্গে অথবা তদপেক্ষা নিম্নবর্ণের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। আর যদি অনুলোম অসবর্ণ বিবাহজাত সন্তান মেয়ে হয় তবে ঐ মেয়ের সঙ্গে অবশ্যই তার পিতৃবর্ণের অথবা তদপেক্ষা উদবর্ধিত বর্ণের ছেলের বিবাহ দিতে হবে।
উপরিউক্ত দু’ধরনের বিবাহের ক্ষেত্রেই শাস্ত্রানুমোদিত কয়েকটি বিশেষ ধরনের মানবগুচ্ছ ছাড়া সবক্ষেত্রেই স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। এগুলি ছাড়াও শাস্ত্রে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের বয়স, বংশ, গোত্র, মেধা-শিক্ষা, আয়ু, স্বাস্থ্য ইত্যাদি আরও বিভিন্ন সূক্ষè সূক্ষè বিষয় গভীরভাবে বিবেচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্দেশিকার উল্লেখ রয়েছে। সুসদৃশ বিবাহের জন্য এই সকল নীতি বিধির সুষ্ঠুভাবে পরিচালন করা জাতির প্রত্যেকের পক্ষেই বিশেষ পালনীয় কর্তব্য। আর তাই পরম প্রেমময় শ্রীশ্রী ঠাকুর বলেছেন,
সবর্ণে সগোত্রে বিয়ে দিসনে কোন দিন ভুলে,
করবে বংশ জরাজীর্ণ অসংবদ্ধ সগুণ বহুলে।।
বিশ্ববরেণ্য স্বামী বিবেকানন্দের চতুর্বর্ণ সম্পর্কে এবং এ ছাঁচে বৈদেশিক প্রণালীতে দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এছাড়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু মনীষীগণ আর্য্য সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান এই বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে দৃঢ়চিত্তে সুপ্রজননের এক মূল্যবান চাবিকাঠি রূপে অবিহিত করেছেন।
পরমপিতা, যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের বর্ণাশ্রম সম্পর্কে কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের উল্লেখ করছি।
‘‘শূদ্রইতো জাতির চাকা,
বৈশ্য যোগায় দেশের টাকা,
ক্ষত্রিয়েরা রাজার জাত
সবার পূরন বিপ্র ধাত।’’
সুপ্রজননের প্রধান ভিত্তিই হল বর্ণাশ্রমানুগ সুসদৃশ্য বিবাহ এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রী ঠাকুরের কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি।
‘‘-----সাবধান বিবাহকে খেলনা ভাবিওনা, যাহাতে তোমার জীবন ও জনন জড়িত।’’ ভক্তদের সঙ্গে কথা বললেন- ‘‘বিয়ের গোলমালের ভিতর দিয়ে বহু পাপ, বহু অপরাধ সমাজে ঢুকে গেছে ও যাচ্ছে। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বিবাহ সুনিয়ন্ত্রিত করা, যার ফলে কুজনন তিরোহিত হয়ে সমাজে সুস্থ দেহ মনওয়ালা জাতকের সংখ্যা বেড়ে যায়।’’
এ জন্যই শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বর্তমানে মানুষের উন্নতির মূল ভিত্তি বর্ণাশ্রমানুগ বৈধ বিবাহ এবং স্বামী-স্ত্রীর আদর্শপ্রাণ প্রেম ভালবাসাপূর্ণ দাম্পত্য জীবনের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি তাঁর ‘নারীর পথে’ গ্রন্থের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন-
‘‘মানুষের মনে জ্ঞান ও অজ্ঞান দুইয়েরই সমাবেশ থাকে। জ্ঞানে উৎকর্ষ, অজ্ঞানে অপকর্ম। মানুষ সাধারণতঃ অজ্ঞানবশতঃ নিকৃষ্টকে সাময়িকভাবে তাহার জীবন ও বৃদ্ধির অনুকূল বলে গ্রহণ করে অশেষ ব্যর্থতা এবং অবসাদে জীবন নষ্ট করতে চাইতে পারে এবং সে ভ্রান্তির ফলেরও আবার একটা পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ক্রমাগতি আছে। তাহলে যা জীবনকে এমনতরভাবে বিব্রত করে মৃত্যুর দিকে চালিত করে। এমন পাপ যাতে সমাজকে বিক্ষুব্ধ করতে না পারে। সে জন্য ঋষিরা বিবাহে বর্ণ, বংশ, বিদ্যা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা ইত্যাদি বিচার করে কন্যার পুরুষকে বরণ করার বিধান দিয়েছেন।’’
তবে পরিতাপের বিষয় হল, বর্তমানকালে বহু অভিভাবকরাও বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপাত্রী নির্বাচনে বর্ণ, বংশ, আদর্শ, কুলকৃষ্টি, স্বাস্থ্য, বয়স, শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে ঋষি প্রদত্ত বিবাহ বিজ্ঞানানুসারে বিবেচনা করেন না। বরং তারা বাহ্যিক চাকচিক্য এবং আর্থিক অবস্থাকেই ছেলে, মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সমাজের প্রতিটি মানুষকে আর্য ঋষি বিজ্ঞানীদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বিজ্ঞানসম্মত বর্ণাশ্রমভিত্তিক বিবাহবিধি প্রজনন বিদ্যার নীতি সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন করে তুলতেই হবে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সুপ্রজননের জন্য প্রথমে বর্ণাশ্রমানুগ শাস্ত্র সম্মত বৈধ বিবাহ এবং পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালবাসার নিরবিচ্ছিন্নতা অবশ্যই চাই। এই রূপ বিবাহে যে সন্তান পাওয়া যাবে তারা খুবই সুস্থ সবল ও শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন হবে। তাদের জন্মগত সহজাত প্রবৃত্তিই থাকবে সততা ও আদর্শপ্রাণতা। প্রতিকূল পরিবেশের প্রচন্ড প্রভাবে এরা যদি কখনও জীবনে বিপথগামী হয়ও, তবে অনুকূল পরিবেশে পড়লেই আবার অতি সহজেই তাদের মধ্যে সুপ্ত সদ্গুণগুলির বিকাশ ঘটবে। আর তাই পরম দয়াল শ্রীশ্রী ঠাকুরের কয়েকটি বাণীর উল্লেখ করে লেখার যবনিকা টানছি।
‘‘মেয়ে বরে বরণ করে, সেই বিয়েতেই সমাজ বাড়ে’’ / ‘‘উন্নত আর সুপ্রজনন এইতো বিয়ের মূল, যেমন তেমন বিয়ে করে করিস নাকো ভুল’’ / পুরুষের বিয়ে উচ্চ ঘরে, বাড়ে আপদ বংশ মারে, পুরুষের বিয়ে নিম্নঘরে উন্নতিতে সমাজ বাড়ে।’’ / ‘‘যে ভাবেতে স্বামী-স্ত্রী করবে উদ্দীপিত, সেই রকমই ছেলে পাবে তেমনি সজ্জীবিত’’ / অভ্যাস ব্যবহার যেমনতর সন্তান ও পাবি তেমনতর’’।
লেখক:
সভাপতি, সিলেট জেলা সৎসঙ্গ
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।
বর্তমানে কে কি বর্নের তা নির্ণয় করবো কেমনে?
ReplyDelete