চলার পথে কত অন্যায় কত পাপ করেছি। সে তুলনায় শাস্তি পেলাম কই? অনাদর ভৎসনা যা ছিটেফোটা পেয়েছি, তা আরো বেশী তাঁকে কাছে পাওয়ার আকর্ষণ করে। এজন্য বুঝি ঠাকুরকে পরমপ্রেমময় বলে। তাই বুঝি হেম কবি বলেছিলেনÑআমরা আশ্রমে ঠাকুরের আশ্রয় নয়, ঠাকুরের প্রশ্রয়ে আছি।
ঠাকুরবাড়িতে বহুবার গিয়েছি। কত আশা নিয়ে কত বড় হামবড়াই ভক্তহৃদয় নিয়ে গিয়েছি। ২০০৩ সালের একটা ঘটনাÑসকালে পূজনীয় বাবাইদার দর্শন প্রণাম চলছে। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। কেউ রোগ চিকিৎসা, কেই ঘরবাড়ি দোকানপাট, ব্যবসা বানিজ্যর দিক নির্দেশনা, কেউ বিয়ে, হাজারো রকমের সমাধান দিচ্ছেন দাদা। এবার আমার পালা বুকের ভিতরটা ভয়ে কাঁপছিল। আমার হাতে ঝর্না নামের একটা মেয়ের ছবি। ছবিটি দাদার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে বললাম এই মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে। আাপনার আশীর্বাদ চাই। পূজনীয় দাদা ছবিটি দেখলেনই না, বললেনÑছবি দেখে আমি কিছু বুছি না। দুঃখ পেলাম। আমার আগে একটি ভারতীয় মেয়েÑদাদাকে দুটি ছেলের ছবি দেখালেন। দাদা ছবি দুটি হাতে নিলেন এবং বললেন দুটোই ভাল ছেলে। যে তোমার বেশী পছন্দ তাকে বিয়ে করতে পার। অথচ দাদা আমার বেলায় বললেনÑছবি দেখে কিছু বুঝি না। দেশে ফিরে গিয়ে মেয়েটাকে ‘না’ বলার ভাষা আমার জানা নেই। দুপুরে ঋত্বিক অধিবেশনে পূজনীয় বাবাইদা একটা গল্প বললেনÑকোলকাতার এক জমিদার শিল্পপতি (অদীক্ষিত) একদিন কোন এক ঋত্বিকদাদার যাজনে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখার মানসে নিজের গাড়ী নিয়ে দেওঘর অভিমুখে রওনা দিয়েছেন। মাঝপথে মাঝরাতে গাড়িটি যান্ত্রিক ত্র“টি দেখা দিল এবং ভদ্রলোক সহযাত্রী গাড়ীর ভিতরে বসেই রাত পার করলেন। ভোর বেলা জমিদার লোক পাঠিয়ে গ্যারেজ মালিককে খুঁজে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গাড়ি মেরামতের কাজে লাগালেন। ম্যাকানিক জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাচ্ছিলেন? জমিদার খানিকটা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেনÑসৎসঙ্গ ঠাকুরবাড়ি। ম্যাকানিক বললেনÑসেজন্য ঠাকুর বাঁচালেন। ঠাকুর তার ভক্তদেরকে এভাবে বাঁচান। গত রাত ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত এই রাস্তায় যত গাড়ি সব আটকিয়ে সন্ত্রাসীরা ডাকাতি করেছে, অনেকে মারাত্মক জখম হয়েছে। আপনাদের গাড়ি খারাপ হওয়াতে বড় বাঁচলেন। পূজনীয় বাবাইদা বললেনÑএটা পুরুষোত্তমের লীলাক্ষেত্র, পরমতীর্থ। সে দীক্ষিত হোক বা না হোক ঠাকুরবাড়িতে যদি কেউ আসে তার কল্যান হয়ই । দাদার গল্পশুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। একবার যখন মালিকের শ্রীচরণে নিবেদন করতে পেরেছি হ্যা না যা ঘটুক তাতেই আমার মঙ্গল। দেশে ফিরে যা ঘটল তা নেহাতই তাঁর দয়া। জানলাম যে, একটা ছেলের সঙ্গে মেয়েটির নিবিড় সম্পর্ক ছিল তিনি আমাদের বিয়ের খবরটি জানতে পেরে মেয়েটাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে গেছে, কিছুদিন পর তারা বিয়েও করল। মাথার ভিতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলÑযদি মেয়েটা অন্য ছেলেকে গভীর ভালোবাসে তবে কেন সে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হল? জানলাম, ঐ-ছেলেটা তার স্কুল ও কলেজ লাইফের গৃহশিক্ষক ছিল। যৌবনের উচ্ছাস, আবেগ, শিক্ষকতার সুযোগে নিভৃতে অবাধ মেলামেশা এসব কারণেই তাদের মধ্যে যা হবার তাই-ই হয়েছে। কিন্তু সে আবেগ কেটে গেলেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসে যেÑবিয়ে মানে কি? বর অর্থ কি? সংসার কি? বাবা-মার ইচ্ছা কি? সামাজিক মর্যাদা কেমন করে পাওয়া যায়? সুপ্রজনন কাহাকে বলে? তখন থেকেই মেয়েটা ছেলেটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এবং আমাকে তার উপযুক্ত বলে মনে করে। মাঝে-মাঝে ভাবী, অবাক হই! এ-রকম হাজার-হাজার লক্ষীস্বরূপিনী মেয়েরা প্রতিনিয়ত লোভী-পরশ্রীকাতর ছেলেদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে তাদের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রই বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, কারণ সু-প্রজনেনর সুসন্তান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাতি। সত্যিই আমি স্বচক্ষে সশরীরী একটা মেয়েকে সাতদিন ধরে এত কাছ থেকে দেখেও বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি যে, সে অন্যের। কিন্তু মালিক অন্তর্যামী না দেখেই বলে দিলেনÑছবি দেখে মানুষ চেনা যায় না। মন দিয়ে ভালোবাসলে তাঁর হ্যা না-র অর্থ বোঝা যায়। বোঝে প্রাণ বোঝে যার। মন বার বার গেয়ে ফিরেÑ
এমন অনেক কথাই বল তুমি মন থেকে যা বল না
আবার অনেক তোমার সত্যি কথা আমি ভাবি ছলনা।
ভালোবাসার কোন কথাটির কি যে আসল মানে
ভালো যারা বেসেছে গো তারাই শুধু জানে।
অল্পদিনের মধ্যে আমারও বিয়ে হল। ঠিক যেমন মেয়ে আমি খুঁজছিলাম। মেয়েটির বাড়ি সৎসঙ্গ মন্দিরের কাছে হওয়াতে বিভিন্ন সময়ে ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠায় অত্র মহল্লার অনেকেই সাহার্য্যরে হাত বাড়িয়েছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“দম্ভ , অভিমান ও আত্মম্ভরিতার আপূরণী প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর কাছে যদি যাও, হাজার যাওয়াতেও যাওয়া হবে না। ভাব, ভক্তি,ভালোবাসা যদি তার বিপরীত সংঘাতে উদ্দামই না হইল, তবে তা আদৌ ছিল কিনা সন্দেহযোগ্য বটে! যদি এতটুকু লোকনিন্দা, উপহাস, স্বজনানুরক্তি, স্বার্থহানি, অনাদর, আত্ম বা পরগঞ্জনা তোমার প্রেমাস্পদ হ’তে তোমাকে দূরে রাখতে পারে, তবে তোমার প্রেম কতই ক্ষীণÑ তা’ নয় কি?”
গুরু যদি অপমান করেন বাড়েই শিষ্যের মান,
তাড়ন-পিড়ন-ভৎসনায় হয় জ্ঞানে অভিযান।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কোন জাতীয় ব্যবসা করব ইত্যাদি জানিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে পূজনীয় বাবাইদাকে জানালাম। কিছুদিন পর উত্তর দিলেনÑ“আপনার চিঠি পড়ে আমি কিছু বুঝলাম না”। দুঃখ পেলাম। আবার সেই ‘না’! না বোঝার কি আছে? অতি সরল বাংলায় দুটো কথা মাত্র। মনে মনে হাসি পেল, হে মালিক! আমার কোন কথা তোমার কোনদিন কখন না বুঝলেও চলবে, কিন্তু তোমার হ্যা না কোন কথার কি মানে দয়া করে আমার বোঝার জ্ঞান দিও। তারপর লিখলেনÑ“সপরিবার সাবধানে থাকবেন। ভয় নেই ঠাকুর আছেন।” আমি তো পরিবারের কারো ব্যাপারে কিছু লিখিনি। তবে কেন তিনি আমাকে সাবধান থাকতে বললেন! নিশ্চয় কোন দিক থেকে কোন বিপদ বা ষড়য›েত্রর শিকার হচ্ছে আমার পরিবারের কেউ না কেউ। আমি শহরে থাকি, গ্রামের বাড়ির খুঁটি-নাটি জানি না। গ্রামেরবাড়ির সকলের ব্যাপারে তন্ন তন্ন করে খোঁজ নিয়ে জানলামÑআমার পরিবারের একান্ত আপনজন এমন একটি জালে আটকে গেছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা মুশকিল। তবে, যথাসময় সাবধান হওয়াতে আমার কোন ক্ষতি হল না বরং বেশ লাভবান হলাম। এভাবে কতভাবে কত আপদ থেকে যে তিনি আমাদের রক্ষা করে চলেছেন শুধুই তিনি জানেন। অবুঝ শিশু যেমন জানে না পিতা-মাতা ভালোবাসার পরিমাপ কি! ইং ১৯৯৩ সালের কথা, সৎসঙ্গ বিহার খুলনার নির্ম্মান কাজ ধীরগতিতে চলছে। অচিন্ত্যদা সব কাজ দেখেন। আমি সবে দু’বছর হল প্রাইভেট চাকরিতে ঢুকেছি। চাকরির শর্ত Ñডিউটি সপ্তাহে সাতদিন, রাত-দিন ২৪ ঘন্টা, ঐ মৎস ডিপোর অফিসেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, যাতে পার্টিরা ২৪ ঘন্টা সেবা পায়। হায় ভগবান! কপালে আর কত কি লেখা আছে! নিরামিষ খাই, তারপর মৎস ডিপোতে চাকরি। কিন্তু চাকরীটা আমার একান্ত দরকার। পয়সার অভাবে লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়েছে। মেসের ভাড়া না দিতে পেরে মন্দিরের ছোট্ট একটা ভাঙ্গা ঘরে থাকি, ঘরের ছাউনির যে হাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে আকাশের দু’চারটে তারা গোনা যায়, বর্ষার দিনে কত রাত যে এককোনে বসে কাটিয়েছি তার ঠিক নেই। রান্না খাওয়া ও বার্থরুমের কোন নির্দিষ্ট স্থান মন্দিরে ছিল না। ওসব পাশের বাড়ি থেকে মিটাতে হত। ঐ-সময়টা মন্দির না বলে বলা যায় প্রার্থনালয়। যত কষ্টই হোক চাকরীটা ছাড়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না, কারন পেট নামক চাহিদার পরিপূরণ ওটা থেকে চলছে। বেশী দিন তো নয়, ছাত্রাবাসে পয়সার অভাবে তিন দিন শুধু জল খেয়ে কাটিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল শ্বাসযন্ত্রটা বুঝি বন্ধ হয়ে এল। বুঝলাম, প্রত্যেকটা জীবের মধ্যে ক্ষুধা বলে একটা হাহাকার আছে। তা পূরণ করতে ন্যায় অন্যায় বোধ লোপ পায়। একদিন অচিন্ত্যদা বললÑউপনয়ন ব্রতটা করা লাগে। দেওঘরে আচার্য্যদেবের নিকট লিখে জানাতে উত্তরে নির্দেশ পাওয়া গেল। কিন্তু যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ওর ভিতর দিয়ে ৩৬ দিনের ব্রত ! শেষের দিকে জীবন যায় যায় অবস্থা, একদিন গা-মাথা ঘুরে অফিসেই পড়ে গেলাম। অফিসে এত বেশী লেখার কাজ ছিল যে, মাঝে-মাঝে একটা নতুন বলপেন একদিনই শেষ হয়ে যেত। দ’ুদিনের ছুটি নিয়ে দেওঘর গেলাম উপনয়ন নিতে। আমার কাজের যা অবস্থা একঘন্টা ছুটি চাওয়া অন্যায় আবদার, তারপর দু’দিন! আচার্য্যদেবের নির্দেশ মত অজিত গাঙ্গুলিদার ব্রতঘরে ঢুকলাম। জানলাম, ৮-১০ দিন তো থাকা লাগে। শুনেই দুঃচিন্তায় পড়লাম, অজিতদার শিখানো মন্ত্র-তন্ত্র সব ভুলে অফিস হল আমার জপ-তপ। আমার অফিসে দৈনিক ৫০-৬০ লক্ষ টাকা নগদ পাটিদের দিতে হয়। আমার জায়গায় অন্য কেউ তা করতে পারবে না, তাছাড়া তেমন কেউ তো অফিসে নেই যে সে করবে। চাকরী তো যাবেই তাতে কোন দুঃখ নেই, কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠান যে পরিমান আর্থিক ক্ষতির ফিরিস্তি দেখাবেন, আর আমাকে আমার দায়িত্ব-জ্ঞান সমন্ধে যে ভাষা ব্যবহার করবেন তাতে আমার ঠাকুরকে আমি বড় বিপাকে ফেললাম। ৩-৪ দিন বড় টেনশনে কাটালাম। একদিন অজিতদার স্ত্রী ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে ব্রতঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেনÑআচার্য্যদেব এই ফল-প্রসাদ পাঠিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে যারা সন্ন্যাসী তাদের দিতে, নাও । আচার্য্যদেব কে? সে সমন্ধে আমার ধারণা তখন কম ছিল, তাই ফল পেলেও বিফল মনোরথ বড্ড পীড়া দিচ্ছিল। যাহোক, দেশে ফিরে ১০ দিন পর মনে-প্রানে চাকরী চলে যাওয়ার মানসিকতা ও প্রস্তুতি নিয়েই ভয়ে-ভয়ে অফিসে ঢুকলাম। দুর থেকে বস্-এর মুখখানা দর্শন করলাম। বুঝলাম, যখন জমেছে মেঘ আকাশে বৃষ্টি না হয় যদি ঝড় তো হবে। ভেবেই নিয়েছি মন্দিরে মিস্ত্রিদের সাথে লেবার দিয়ে পেট চালাব। কিন্তু যা সাত-সতের ভাবছিলাম তার কিছুই ঘটল না। অতীতের নিয়ম অনুযায়ী বস্ একখানা ৪০ লাখ টাকার চেক দিয়ে শান্ত গলায় বললেনÑব্যাংকে যান, আমি ম্যানেজারকে ফোনে বলেছি। ড্রাইভারকে আমার জন্য গাড়ি আনতে নির্দেশ দিয়ে অফিস ত্যাগ করলেন। বস্ তো তিরস্কার করলেন না, বুকের যন্ত্রনা আরও বাড়ল। নাটকে পড়েছিলামÑ ঝড়-বৃষ্টির একটা ভাল দিক আছে কিছুক্ষণ হরদম বৃষ্টি রাস্তা-ঘাট ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করে থেমে যায়, কিন্তু ফিসফিসে বৃষ্টি রাস্তা কর্দমাক্ত করে, আর ক্ষনে-ক্ষনে বাড়ে-কমে, থামতেই চায় না। নীচগলায় অফিস পিয়ন শাহাবুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলামÑকি অবস্থা? বললÑখুব খারাপ! বউ আমার সংসার করবে না। বলেছেÑচাকরী নিয়ে থাক, বাড়ী এসো না। ও-সব পরে শুনব, বলছি, অফিসের কি হাল? বললÑআপনি যেদিন ভারতে গিয়েছিলেন, ঐদিনই কালিগঞ্জ থেকে কৃষ্ণদা (অভিজ্ঞ হিসাবী লোক) এসেছিল, ১০-দিন অফিসের ঐরুমে ছিলেন, আজ সকালে চলে গেছেন। ওখানকার ডাক্তার তাকে খুলনায় কোন ভাল মেডিসিন ডাক্তার দেখাতে নির্দেশ করেছিলেন। এ-পরীক্ষা সে-পরীক্ষা, রিপোট দেখানো, আবার ডাক্তারের সঙ্গে রাত্রে) রোগ-অবস্থার পরিবর্তন জানানো এইসব করেছেন, তবে আপনার সব কাজ কৃষ্ণদা নিয়মিত করেছেন। দয়াল! তোমার যে কি দয়া! তোমার দৃষ্টির বাহিরে কিছু নেই। আমার ইহজীবনে এমন কোন পুণ্যি সঞ্চয় নেই যে তোমার এত বড় দয়া পাব। যদি থাকে কিছু তবে তা পূর্বজন্মের। শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বাণী প্রায়ই বলি যাতে ভুলে না যাই। কারণ এটি আমার পোষাক ছাড়া শরীরের ভেতরের চরিত্র ও চিত্র। বাণীটিÑ
দুর্দ্দশাতে কাবু যখন বৃত্তি কাবু তায়
বাঁচার টানে মানুষ তখন বিধির পাণে ধায়,
বিধির পথে পুষ্টি পেয়ে চিত্ত সবল হলে
বৃত্তিধান্ধার স্বার্থ নিয়ে আবার ছুটে চলে;
এমনি করে ওঠা-পড়ায় মরণ-মুখে ধায়
ইষ্ট উৎসর্জ্জনে কিন্তু সবই পাল্টে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“অভাবে পরিশ্রান্ত মনই ধর্ম্ম বা ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা করে, নতুবা করে না।” শ্রীমদ্ভাগবতগীতায়ও আছেÑ‘তস্মাৎ গুরুং প্রপদ্যেত, জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয়মুত্তমম্।’ Ñনানা দুঃখ-দুর্দশা-জর্জরিত জীব দুঃখের কবল হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে গুরুর শরণাগত হয়। কিন্তু, আমার ব্যথা ও ব্যর্থতা ওখানেÑ“ বিধির পথে পুষ্টি পেয়ে চিত্ত সবল হলে বৃত্তিধান্ধার স্বার্থ নিয়ে আবার ছুটে চলে।” এত নাকানি-চুবানি, এত নরক-যন্ত্রনা কেমন করে মানুষ এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে গিয়ে আবার ভুল পথে চলে! ঠাকুর বলেছেনÑ“কোন-কিছু আজ বুঝেছি আবার কাল বোঝা যায় নাÑহেঁয়ালি ইত্যাদি বলে শৃগাল সেজো নাÑকারণ, ইতর জন্তুরাও যা বোঝে তা ভোলে না।” আমাদের অনেকের অনেক দোষ আছে, পরের টাকা আত্মসাৎ, পরস্ত্রীগ্রহণ, চুরিদারী, মিথ্যাবলা ইত্যাদি। একদিন দেওঘর সন্ধ্যা প্রার্থনান্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বাণী পাঠ করে শোনানো হল, শ্রীশ্রীদাদা যখন নিজ পার্লারে বসলেনÑতখন ভক্ত-পার্ষদদের ঐ বাণীর কথা উল্লেখ করে বললেন, “ওর ফল যে কি ভয়াভহ তা আমার ভাল করে জানা আছে। আমরা বার বার সংকল্প করি এটা করব না। এটা করা অন্যায়, পাপ। আবার মনে ভাবিÑ আজ করে নিই, কাল থেকে আর করব না। ফের আবার করি। এই করতে-করতে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনি। প্রবৃত্তির হাতের ক্রীড়ানক হয়ে উঠি। শেষে পরজন্মে শিয়াল-কুকুর হয়ে জন্মানো ছাড়া পথ থাকে না।” কি সাংঘাতিক বিভৎস ব্যাপার! কত সাধনায় মানব জন্ম পেয়েছি! প্রসঙ্গক্রমে শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীতে রয়েছেÑ“ যখনই তোমার কুকর্ম্মের জন্য তুমি অনুতপ্ত হবে, তখনই পরমপিতা তোমাকে ক্ষমা করবেন, আর ক্ষমা হলেই বুঝতে পারবে তোমার হৃদয়ে পবিত্র সাত্বনা আসছে, আর তাহলে তুমি বিনীত, শান্ত ও আনন্দিত হবে। যে অনুতপ্ত হয়েও পুনরায় সেই প্রকার দুষ্কর্ম্মে রত হয়, বুঝতে হবে সে সত্বরই অত্যন্ত দুর্গতিতে পতিত হবে। মানুষের কুপ্রবৃত্তি তার নিজের কাছে আগে নিজে সমর্থনে গা ঢাকা দিয়ে থাকে, পরে এৎফাঁক করে নানান ভাঁওতায় মানুষের চোখে ধুলো দিতে থাকে, তাই যদি ভালই চাওÑআগে নিজের কাছে নিজে ধরা পড়, সঙ্গে-সঙ্গে তার সুনিয়ন্ত্রন করতে থাক। তুমি যদি তোমার অবাঞ্ছিত চরিত্রের উপর হস্তক্ষেপ না কর, তাকে যথাবিহিত নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে সংস্থ করে না তোল, লাখ শিক্ষিত হও না কেনÑ তোমার স্বাভাবিক উন্নতি তখনও মরীচিকাবৎ।
বৃত্তি-প্রবৃত্তি তাঁরই দানÑকাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি থাকবেইÑএগুলোকে ধফলঁংঃ করতে হবে। তিনি হলেন লঁংঃ, তাঁর সঙ্গে নিজেদেরকে ধফ করলে-ই ধফলঁংঃবফ হওয়া সম্ভব।
ইষ্টের প্রতি টান যত তীব্র
প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ তত শিঘ্র।
২৫ জানুয়ারী-২০১০, আচার্য্যদেব পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদা পার্লারে উপবিষ্ট, এমন সময় পূজনীয় অবীনদা এসে শ্রীশ্রীদাদার কোলে বসলেন। দাদু-নাতীর লীলা মাধুর্য্য অবলোকন করছিলাম ভক্তসকলে মিলে। আমি মনে-মনে নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছিলাম যে, হ্যাঁ এই ছোট্ট ৬/৭ বছরের ছেলেটি একদিন আচার্য্য পদাভিসিক্ত হবেন। একদিন তিনিই হবেন সমগ্র বিশ্ব-সৎসঙ্গের পরিচালক, সকলের ভাগ্য নিয়ন্তা। পূজনীয় বাবাইদা একদিন ঋত্বিক অধিবেশনে বলেছেনÑ‘সেই-ই প্রথম শ্রেনীর কর্মী যে আচার্য্যকে ঠাকুর বলে জানে।’ আমার সাত-প্যাচে ভরা মনটা বার-বার বলছিল পূজনীয় অবীন বাবু কি তাই? তাও কি সম্বব! এতটুকু বাচ্চা ছেলে! এমন সময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। অবীনদা বললেন দাদুকেÑতুমি বেনুদাকে (ড্রাইভার) বলে দাও আমি গাড়িতে ঘুরতে বের হব। শ্রীশ্রীদাদা বললেনÑতুমি বল, তুমিও যা আমিও তাই। আমরা সবাই সমান। অবীনদা আবার বললেনÑ আমি বললে ও গাড়ী আনতে যাবে না, তুমি বললে যাবে। শ্রীশ্রীদাদা বললেনÑবলেই দেখ না, তুমি বললে যা হবে আমি বললেও তাই হবে। অবীনদা বেনুদাকে গাড়ী আনতে বললেন। বেনুদা দৌড়ে গাড়ী আনতে ছুটল। অন্তর্যামী শ্রীশ্রীদাদা অবীন বাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে-করতে আমার অন্তরের প্রশ্নের সমাধান দিলেন কবিতার ভাষায়। আমার অবিশ্বাসী পাপিষ্ট মনের ময়লা দূর হল। শ্রীশ্রীদাদা আবৃত্তি করলেনÑ
আমরা সবাই রাজা
আমাদেরই রাজার রাজত্বে।
নইলে মোদের রাজার সনে
মিলব কি শর্তে।
আমরা যা খুশি তাই করি
তবু তার খুশিতে চলি।
আমরা চলব আপন মতে
তবু মিলব তার সাথে।
রাজা সবারে দেয় মান
সে মান সবই ফিরে পান।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীতে আছেÑ
মানুষেরে প্রীত করে দীপ্তি পান যিনি,
এই দুনিয়ায় তিনিই রাজা তোমার রাজাও তিনি।
ইষ্টে রেখো ভক্তি অটুট শক্তি পাবে বুকে,
তারই কর্মে রাঙাও স্বভাব পড়বে নাকো দুঃখে।
প্রায় বিশ বছর যাবৎ ঠাকুরের এই অভয় বাণী কখনও বলি, কথনও বা শুনি। কিন্তু নির্ভরতা কোথায় যে ফল পাব? ভক্তি, বিশ্বাস সাধন-ভজন কোথায় আমার? শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য সহপ্রতিঋত্বিক, সিলেট, তাকে আমার ভাল লাগে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ইষ্টধান্ধায় ব্যয় করে চলেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কেন্দ্র-মন্দিরে তার প্রেরণা, সহযোগীতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। ঠাকুর পরিবারের সকলেই তাকে বড় ভালবাসেন। ২০ বৎসর আগের কথা তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি তার নামও জানি না, তিনিও আমাকে চিনে না। প্রথম দেখাতেই আমাকে অত্যন্ত সিক্রেট একটা ব্যাপারে সতর্ক করলেন। বললেনÑতোমাকে দেখেই আমার এমন মনে হল, সাবধান! কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেল। কি আশ্চার্য! বিশিষ্ট জ্যোতিষী আমার কুষ্টি গণনা করে ঐ একই কথা লিখলেন। অধ্যক্ষ সুনিল বিশ্বাসের বাড়িতে প্রথম যেয়ে তার একমাত্র মেয়ে পাপিয়াকে দেখেই দাদা বললেনÑতোমাকে দেখে আমার মনে হল তোমার শরীরে কিছু দিনের মধ্যেই একটা রোগ আসবে। তুমি রোজ সকালে নারিকেল তেল মেখে পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করবে। সে বললÑও বাবা! আমি পারব না। কিছুদিন পরে জানলাম মেয়েটিকে চিকিৎসার জন্য ৩-বার সিঙ্গাপুর নেওয়া লাগছে। একটা ঘটনা না বললে নয়Ñরামকৃষ্ণদার ডাকে ১৫ জানুয়ারী মদন উৎসবে গিয়েছি। তবে এবার বাড়ি থেকে আমার বের হওয়াটা ছিল ভিন্নরকম। বউকে বললামÑআমার বলতে আর কিছুই নেই, এ-সংসারে যা কিছু সব তোমার আর তোমার সন্তানদের, আমার ছুটি। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। আমি এখন শুন্য, ঠাকুরই আমার ভরসা, চললাম। উৎসব হল, দীক্ষাও হল। তারপর রামকৃষ্ণদার সঙ্গে সিলেট গেলাম। তার মেয়েটাকে দেখে দিলুদাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কি পড়ছে? বললÑমেডিকেল পড়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল, সরকারীভাবে সুযোগ হয়নি। এখানে প্রাইভেট মেডিকেল পড়তে রাবেয়াতে বহু টাকার ব্যাপার! তাছাড়া টাকা হলেও এ-বছর আর কোন প্রকার সুযোগ নেই। মায়ের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তার মেয়ে মেডিকেল পড়তে না পারায় মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে, কিন্তু বাহির থেকে কিছুই বোঝার জো নেই। মা ও মেয়ের ১৫ বছরের সাধনার অকালমৃত্যু যা’ তা’ শোক নয়! তবে মেয়ে খোলা মনে বললÑআমি ভেবেছি, এবৎসর দেশের বিভিন্ন চার্মিং স্পটে ঘুরে বেড়াব, আগামী বৎসর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হব। রামকৃষ্ণদার মেয়ে আইএসসি পাশ করেছেÑআমি জানতাম না। এখানে এসে জানলাম। তাছাড়া ওনার কাছে হাজারও মানুষ রোগ-শোক নিয়ে প্রতিনিয়ত আসে। কিন্তু নিজের সুখ-দুখের কথা ভুলেও কাউকে বলতে শুনি নাই। সর্বক্ষণ তো ইষ্টপ্রসঙ্গে মাতোয়ারা থাকেন। রাত্রে শুয়ে-শুয়ে ভাবছি এতবড় একটা স্বপ্ন ব্যর্থ হতে চলেছে, দাদার অভিমত কি? ফোনে দাদা বললেনÑআমি কোনদিন ঠাকুরের কাছে কিছুই চাইনি। আমার কিসে মঙ্গল তিনিই তা জানেন। হ্যাঁ না যা হোক সব কিছু তাঁর ইচ্ছা, আর এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দাদা তখন পাবনা অবস্থান করছেন, পূজনীয় বিংকিদার নির্দেশে ও আচার্য্যদেবের আশীর্বাদ বাস্তবায়নে রত আছেন। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সুবিদ চক্রবর্তীদাকে বললামÑআমাদের খুলনায় একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হয়েছে। যার প্রিন্সিপাল আমাদের গুরুভাই, নাম ডাঃ শৈলেন মিস্ত্রী। সুবিদদা শুনেই বললেনÑতার ছেলে ও মেয়েকে আমি মুখে ভাত দিয়েছিলাম। বললামÑদেখি চেষ্টা করে কি করা যায়। ডাঃ শৈলেনদা রামকৃষ্ণদাকে আগে থেকেই জানতেন। গভীর শ্রদ্ধা করেন তাকে। শৈলেনদা বললেনÑআমাদের কলেজে ভর্তি শেষ হয়ে গেছে, অতিরিক্ত ১০ টি আসনের জন্য বোর্ডে অনুমোদন চেয়েছি। যদি অনুমোদন পাই তবে রামকৃষ্ণদার মেয়ে বিধায় আমার সবরকম চেষ্টা থাকবে। সুবিদদাকেও যথেষ্ট সম্মান দেখালেন শৈলেনদা। অবশেষে ২ দিন পর গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেল, প্রজ্ঞার স্কোর ১২৪, ভর্তির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলÑ২ দিনের ভিতর ১০ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। নইলে অনেক পয়সাওয়ালা বাপ বেশী পয়সা দিয়ে আসন কিনে নেবে। প্রজ্ঞার মুখে শুনলাম আচার্যদেব বলেছেনÑ‘পরম পিতাকে ডাক।’ হয়তো তার ডাক পরমপিতার দরবারে কবুল হয়েছে। প্রজ্ঞা মেডিকেল কলেজে যথাসময়ে মর্যাদার সাথে ভর্তি হল। মাঝে-মাঝে ভাবি তাঁর দয়ায় কি না সম্ভব!
ইষ্টনিষ্ঠা কৃতিচর্য্যায় বিভবের অভাব কি!
ছাইয়ে ফলে সোনা তাদের জলে গজায় ঘি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“মানুষ ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদের পথে যখন চলে, অর্থাৎ তাঁর অনুশাসন পরিপালন করে চলে,Ñতখন তার প্রয়োজনের উপকরণ ভূতে যোগায়। যারা প্রাণে প্রাণে বিশ্বাস করে, প্রাণে প্রাণে ডুবে থাকে তাদের সংসার অচল হয় না। ভগবান মাথায় করে তাদের খাদ্যসামগ্রী এনে থাকে। তাদের পুত্র পৌত্রাদি পর্য্যন্ত সুখে থাকে। যে আমার কাজ করে, তার সাথে আমার আশীর্বাদ ঘোরে। যদি সৎ পরিচালক অবলম্বন করে থাক ভয় নাই, মরবে না; কিন্তু কষ্টের জন্যে রাজী থাক।”
লিখেছেন- অজয় সরকার-( এসপিআর, খুলনা।)
ঠাকুরবাড়িতে বহুবার গিয়েছি। কত আশা নিয়ে কত বড় হামবড়াই ভক্তহৃদয় নিয়ে গিয়েছি। ২০০৩ সালের একটা ঘটনাÑসকালে পূজনীয় বাবাইদার দর্শন প্রণাম চলছে। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। কেউ রোগ চিকিৎসা, কেই ঘরবাড়ি দোকানপাট, ব্যবসা বানিজ্যর দিক নির্দেশনা, কেউ বিয়ে, হাজারো রকমের সমাধান দিচ্ছেন দাদা। এবার আমার পালা বুকের ভিতরটা ভয়ে কাঁপছিল। আমার হাতে ঝর্না নামের একটা মেয়ের ছবি। ছবিটি দাদার দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে বললাম এই মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছে। আাপনার আশীর্বাদ চাই। পূজনীয় দাদা ছবিটি দেখলেনই না, বললেনÑছবি দেখে আমি কিছু বুছি না। দুঃখ পেলাম। আমার আগে একটি ভারতীয় মেয়েÑদাদাকে দুটি ছেলের ছবি দেখালেন। দাদা ছবি দুটি হাতে নিলেন এবং বললেন দুটোই ভাল ছেলে। যে তোমার বেশী পছন্দ তাকে বিয়ে করতে পার। অথচ দাদা আমার বেলায় বললেনÑছবি দেখে কিছু বুঝি না। দেশে ফিরে গিয়ে মেয়েটাকে ‘না’ বলার ভাষা আমার জানা নেই। দুপুরে ঋত্বিক অধিবেশনে পূজনীয় বাবাইদা একটা গল্প বললেনÑকোলকাতার এক জমিদার শিল্পপতি (অদীক্ষিত) একদিন কোন এক ঋত্বিকদাদার যাজনে শ্রীশ্রীঠাকুরকে দেখার মানসে নিজের গাড়ী নিয়ে দেওঘর অভিমুখে রওনা দিয়েছেন। মাঝপথে মাঝরাতে গাড়িটি যান্ত্রিক ত্র“টি দেখা দিল এবং ভদ্রলোক সহযাত্রী গাড়ীর ভিতরে বসেই রাত পার করলেন। ভোর বেলা জমিদার লোক পাঠিয়ে গ্যারেজ মালিককে খুঁজে ঘুম থেকে ডেকে তুলে গাড়ি মেরামতের কাজে লাগালেন। ম্যাকানিক জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাচ্ছিলেন? জমিদার খানিকটা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললেনÑসৎসঙ্গ ঠাকুরবাড়ি। ম্যাকানিক বললেনÑসেজন্য ঠাকুর বাঁচালেন। ঠাকুর তার ভক্তদেরকে এভাবে বাঁচান। গত রাত ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত এই রাস্তায় যত গাড়ি সব আটকিয়ে সন্ত্রাসীরা ডাকাতি করেছে, অনেকে মারাত্মক জখম হয়েছে। আপনাদের গাড়ি খারাপ হওয়াতে বড় বাঁচলেন। পূজনীয় বাবাইদা বললেনÑএটা পুরুষোত্তমের লীলাক্ষেত্র, পরমতীর্থ। সে দীক্ষিত হোক বা না হোক ঠাকুরবাড়িতে যদি কেউ আসে তার কল্যান হয়ই । দাদার গল্পশুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। একবার যখন মালিকের শ্রীচরণে নিবেদন করতে পেরেছি হ্যা না যা ঘটুক তাতেই আমার মঙ্গল। দেশে ফিরে যা ঘটল তা নেহাতই তাঁর দয়া। জানলাম যে, একটা ছেলের সঙ্গে মেয়েটির নিবিড় সম্পর্ক ছিল তিনি আমাদের বিয়ের খবরটি জানতে পেরে মেয়েটাকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে গেছে, কিছুদিন পর তারা বিয়েও করল। মাথার ভিতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলÑযদি মেয়েটা অন্য ছেলেকে গভীর ভালোবাসে তবে কেন সে আমাকে বিয়ে করতে রাজী হল? জানলাম, ঐ-ছেলেটা তার স্কুল ও কলেজ লাইফের গৃহশিক্ষক ছিল। যৌবনের উচ্ছাস, আবেগ, শিক্ষকতার সুযোগে নিভৃতে অবাধ মেলামেশা এসব কারণেই তাদের মধ্যে যা হবার তাই-ই হয়েছে। কিন্তু সে আবেগ কেটে গেলেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসে যেÑবিয়ে মানে কি? বর অর্থ কি? সংসার কি? বাবা-মার ইচ্ছা কি? সামাজিক মর্যাদা কেমন করে পাওয়া যায়? সুপ্রজনন কাহাকে বলে? তখন থেকেই মেয়েটা ছেলেটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। এবং আমাকে তার উপযুক্ত বলে মনে করে। মাঝে-মাঝে ভাবী, অবাক হই! এ-রকম হাজার-হাজার লক্ষীস্বরূপিনী মেয়েরা প্রতিনিয়ত লোভী-পরশ্রীকাতর ছেলেদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে তাদের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রই বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, কারণ সু-প্রজনেনর সুসন্তান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাতি। সত্যিই আমি স্বচক্ষে সশরীরী একটা মেয়েকে সাতদিন ধরে এত কাছ থেকে দেখেও বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি যে, সে অন্যের। কিন্তু মালিক অন্তর্যামী না দেখেই বলে দিলেনÑছবি দেখে মানুষ চেনা যায় না। মন দিয়ে ভালোবাসলে তাঁর হ্যা না-র অর্থ বোঝা যায়। বোঝে প্রাণ বোঝে যার। মন বার বার গেয়ে ফিরেÑ
এমন অনেক কথাই বল তুমি মন থেকে যা বল না
আবার অনেক তোমার সত্যি কথা আমি ভাবি ছলনা।
ভালোবাসার কোন কথাটির কি যে আসল মানে
ভালো যারা বেসেছে গো তারাই শুধু জানে।
অল্পদিনের মধ্যে আমারও বিয়ে হল। ঠিক যেমন মেয়ে আমি খুঁজছিলাম। মেয়েটির বাড়ি সৎসঙ্গ মন্দিরের কাছে হওয়াতে বিভিন্ন সময়ে ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠায় অত্র মহল্লার অনেকেই সাহার্য্যরে হাত বাড়িয়েছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“দম্ভ , অভিমান ও আত্মম্ভরিতার আপূরণী প্রত্যাশা নিয়ে তাঁর কাছে যদি যাও, হাজার যাওয়াতেও যাওয়া হবে না। ভাব, ভক্তি,ভালোবাসা যদি তার বিপরীত সংঘাতে উদ্দামই না হইল, তবে তা আদৌ ছিল কিনা সন্দেহযোগ্য বটে! যদি এতটুকু লোকনিন্দা, উপহাস, স্বজনানুরক্তি, স্বার্থহানি, অনাদর, আত্ম বা পরগঞ্জনা তোমার প্রেমাস্পদ হ’তে তোমাকে দূরে রাখতে পারে, তবে তোমার প্রেম কতই ক্ষীণÑ তা’ নয় কি?”
গুরু যদি অপমান করেন বাড়েই শিষ্যের মান,
তাড়ন-পিড়ন-ভৎসনায় হয় জ্ঞানে অভিযান।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কোন জাতীয় ব্যবসা করব ইত্যাদি জানিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে পূজনীয় বাবাইদাকে জানালাম। কিছুদিন পর উত্তর দিলেনÑ“আপনার চিঠি পড়ে আমি কিছু বুঝলাম না”। দুঃখ পেলাম। আবার সেই ‘না’! না বোঝার কি আছে? অতি সরল বাংলায় দুটো কথা মাত্র। মনে মনে হাসি পেল, হে মালিক! আমার কোন কথা তোমার কোনদিন কখন না বুঝলেও চলবে, কিন্তু তোমার হ্যা না কোন কথার কি মানে দয়া করে আমার বোঝার জ্ঞান দিও। তারপর লিখলেনÑ“সপরিবার সাবধানে থাকবেন। ভয় নেই ঠাকুর আছেন।” আমি তো পরিবারের কারো ব্যাপারে কিছু লিখিনি। তবে কেন তিনি আমাকে সাবধান থাকতে বললেন! নিশ্চয় কোন দিক থেকে কোন বিপদ বা ষড়য›েত্রর শিকার হচ্ছে আমার পরিবারের কেউ না কেউ। আমি শহরে থাকি, গ্রামের বাড়ির খুঁটি-নাটি জানি না। গ্রামেরবাড়ির সকলের ব্যাপারে তন্ন তন্ন করে খোঁজ নিয়ে জানলামÑআমার পরিবারের একান্ত আপনজন এমন একটি জালে আটকে গেছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসা মুশকিল। তবে, যথাসময় সাবধান হওয়াতে আমার কোন ক্ষতি হল না বরং বেশ লাভবান হলাম। এভাবে কতভাবে কত আপদ থেকে যে তিনি আমাদের রক্ষা করে চলেছেন শুধুই তিনি জানেন। অবুঝ শিশু যেমন জানে না পিতা-মাতা ভালোবাসার পরিমাপ কি! ইং ১৯৯৩ সালের কথা, সৎসঙ্গ বিহার খুলনার নির্ম্মান কাজ ধীরগতিতে চলছে। অচিন্ত্যদা সব কাজ দেখেন। আমি সবে দু’বছর হল প্রাইভেট চাকরিতে ঢুকেছি। চাকরির শর্ত Ñডিউটি সপ্তাহে সাতদিন, রাত-দিন ২৪ ঘন্টা, ঐ মৎস ডিপোর অফিসেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, যাতে পার্টিরা ২৪ ঘন্টা সেবা পায়। হায় ভগবান! কপালে আর কত কি লেখা আছে! নিরামিষ খাই, তারপর মৎস ডিপোতে চাকরি। কিন্তু চাকরীটা আমার একান্ত দরকার। পয়সার অভাবে লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়েছে। মেসের ভাড়া না দিতে পেরে মন্দিরের ছোট্ট একটা ভাঙ্গা ঘরে থাকি, ঘরের ছাউনির যে হাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে আকাশের দু’চারটে তারা গোনা যায়, বর্ষার দিনে কত রাত যে এককোনে বসে কাটিয়েছি তার ঠিক নেই। রান্না খাওয়া ও বার্থরুমের কোন নির্দিষ্ট স্থান মন্দিরে ছিল না। ওসব পাশের বাড়ি থেকে মিটাতে হত। ঐ-সময়টা মন্দির না বলে বলা যায় প্রার্থনালয়। যত কষ্টই হোক চাকরীটা ছাড়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না, কারন পেট নামক চাহিদার পরিপূরণ ওটা থেকে চলছে। বেশী দিন তো নয়, ছাত্রাবাসে পয়সার অভাবে তিন দিন শুধু জল খেয়ে কাটিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল শ্বাসযন্ত্রটা বুঝি বন্ধ হয়ে এল। বুঝলাম, প্রত্যেকটা জীবের মধ্যে ক্ষুধা বলে একটা হাহাকার আছে। তা পূরণ করতে ন্যায় অন্যায় বোধ লোপ পায়। একদিন অচিন্ত্যদা বললÑউপনয়ন ব্রতটা করা লাগে। দেওঘরে আচার্য্যদেবের নিকট লিখে জানাতে উত্তরে নির্দেশ পাওয়া গেল। কিন্তু যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ওর ভিতর দিয়ে ৩৬ দিনের ব্রত ! শেষের দিকে জীবন যায় যায় অবস্থা, একদিন গা-মাথা ঘুরে অফিসেই পড়ে গেলাম। অফিসে এত বেশী লেখার কাজ ছিল যে, মাঝে-মাঝে একটা নতুন বলপেন একদিনই শেষ হয়ে যেত। দ’ুদিনের ছুটি নিয়ে দেওঘর গেলাম উপনয়ন নিতে। আমার কাজের যা অবস্থা একঘন্টা ছুটি চাওয়া অন্যায় আবদার, তারপর দু’দিন! আচার্য্যদেবের নির্দেশ মত অজিত গাঙ্গুলিদার ব্রতঘরে ঢুকলাম। জানলাম, ৮-১০ দিন তো থাকা লাগে। শুনেই দুঃচিন্তায় পড়লাম, অজিতদার শিখানো মন্ত্র-তন্ত্র সব ভুলে অফিস হল আমার জপ-তপ। আমার অফিসে দৈনিক ৫০-৬০ লক্ষ টাকা নগদ পাটিদের দিতে হয়। আমার জায়গায় অন্য কেউ তা করতে পারবে না, তাছাড়া তেমন কেউ তো অফিসে নেই যে সে করবে। চাকরী তো যাবেই তাতে কোন দুঃখ নেই, কিন্তু ঐ প্রতিষ্ঠান যে পরিমান আর্থিক ক্ষতির ফিরিস্তি দেখাবেন, আর আমাকে আমার দায়িত্ব-জ্ঞান সমন্ধে যে ভাষা ব্যবহার করবেন তাতে আমার ঠাকুরকে আমি বড় বিপাকে ফেললাম। ৩-৪ দিন বড় টেনশনে কাটালাম। একদিন অজিতদার স্ত্রী ঠাকুরবাড়ি থেকে এসে ব্রতঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেনÑআচার্য্যদেব এই ফল-প্রসাদ পাঠিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে যারা সন্ন্যাসী তাদের দিতে, নাও । আচার্য্যদেব কে? সে সমন্ধে আমার ধারণা তখন কম ছিল, তাই ফল পেলেও বিফল মনোরথ বড্ড পীড়া দিচ্ছিল। যাহোক, দেশে ফিরে ১০ দিন পর মনে-প্রানে চাকরী চলে যাওয়ার মানসিকতা ও প্রস্তুতি নিয়েই ভয়ে-ভয়ে অফিসে ঢুকলাম। দুর থেকে বস্-এর মুখখানা দর্শন করলাম। বুঝলাম, যখন জমেছে মেঘ আকাশে বৃষ্টি না হয় যদি ঝড় তো হবে। ভেবেই নিয়েছি মন্দিরে মিস্ত্রিদের সাথে লেবার দিয়ে পেট চালাব। কিন্তু যা সাত-সতের ভাবছিলাম তার কিছুই ঘটল না। অতীতের নিয়ম অনুযায়ী বস্ একখানা ৪০ লাখ টাকার চেক দিয়ে শান্ত গলায় বললেনÑব্যাংকে যান, আমি ম্যানেজারকে ফোনে বলেছি। ড্রাইভারকে আমার জন্য গাড়ি আনতে নির্দেশ দিয়ে অফিস ত্যাগ করলেন। বস্ তো তিরস্কার করলেন না, বুকের যন্ত্রনা আরও বাড়ল। নাটকে পড়েছিলামÑ ঝড়-বৃষ্টির একটা ভাল দিক আছে কিছুক্ষণ হরদম বৃষ্টি রাস্তা-ঘাট ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করে থেমে যায়, কিন্তু ফিসফিসে বৃষ্টি রাস্তা কর্দমাক্ত করে, আর ক্ষনে-ক্ষনে বাড়ে-কমে, থামতেই চায় না। নীচগলায় অফিস পিয়ন শাহাবুদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলামÑকি অবস্থা? বললÑখুব খারাপ! বউ আমার সংসার করবে না। বলেছেÑচাকরী নিয়ে থাক, বাড়ী এসো না। ও-সব পরে শুনব, বলছি, অফিসের কি হাল? বললÑআপনি যেদিন ভারতে গিয়েছিলেন, ঐদিনই কালিগঞ্জ থেকে কৃষ্ণদা (অভিজ্ঞ হিসাবী লোক) এসেছিল, ১০-দিন অফিসের ঐরুমে ছিলেন, আজ সকালে চলে গেছেন। ওখানকার ডাক্তার তাকে খুলনায় কোন ভাল মেডিসিন ডাক্তার দেখাতে নির্দেশ করেছিলেন। এ-পরীক্ষা সে-পরীক্ষা, রিপোট দেখানো, আবার ডাক্তারের সঙ্গে রাত্রে) রোগ-অবস্থার পরিবর্তন জানানো এইসব করেছেন, তবে আপনার সব কাজ কৃষ্ণদা নিয়মিত করেছেন। দয়াল! তোমার যে কি দয়া! তোমার দৃষ্টির বাহিরে কিছু নেই। আমার ইহজীবনে এমন কোন পুণ্যি সঞ্চয় নেই যে তোমার এত বড় দয়া পাব। যদি থাকে কিছু তবে তা পূর্বজন্মের। শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বাণী প্রায়ই বলি যাতে ভুলে না যাই। কারণ এটি আমার পোষাক ছাড়া শরীরের ভেতরের চরিত্র ও চিত্র। বাণীটিÑ
দুর্দ্দশাতে কাবু যখন বৃত্তি কাবু তায়
বাঁচার টানে মানুষ তখন বিধির পাণে ধায়,
বিধির পথে পুষ্টি পেয়ে চিত্ত সবল হলে
বৃত্তিধান্ধার স্বার্থ নিয়ে আবার ছুটে চলে;
এমনি করে ওঠা-পড়ায় মরণ-মুখে ধায়
ইষ্ট উৎসর্জ্জনে কিন্তু সবই পাল্টে যায়।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“অভাবে পরিশ্রান্ত মনই ধর্ম্ম বা ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা করে, নতুবা করে না।” শ্রীমদ্ভাগবতগীতায়ও আছেÑ‘তস্মাৎ গুরুং প্রপদ্যেত, জিজ্ঞাসুঃ শ্রেয়মুত্তমম্।’ Ñনানা দুঃখ-দুর্দশা-জর্জরিত জীব দুঃখের কবল হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে গুরুর শরণাগত হয়। কিন্তু, আমার ব্যথা ও ব্যর্থতা ওখানেÑ“ বিধির পথে পুষ্টি পেয়ে চিত্ত সবল হলে বৃত্তিধান্ধার স্বার্থ নিয়ে আবার ছুটে চলে।” এত নাকানি-চুবানি, এত নরক-যন্ত্রনা কেমন করে মানুষ এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে গিয়ে আবার ভুল পথে চলে! ঠাকুর বলেছেনÑ“কোন-কিছু আজ বুঝেছি আবার কাল বোঝা যায় নাÑহেঁয়ালি ইত্যাদি বলে শৃগাল সেজো নাÑকারণ, ইতর জন্তুরাও যা বোঝে তা ভোলে না।” আমাদের অনেকের অনেক দোষ আছে, পরের টাকা আত্মসাৎ, পরস্ত্রীগ্রহণ, চুরিদারী, মিথ্যাবলা ইত্যাদি। একদিন দেওঘর সন্ধ্যা প্রার্থনান্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি বাণী পাঠ করে শোনানো হল, শ্রীশ্রীদাদা যখন নিজ পার্লারে বসলেনÑতখন ভক্ত-পার্ষদদের ঐ বাণীর কথা উল্লেখ করে বললেন, “ওর ফল যে কি ভয়াভহ তা আমার ভাল করে জানা আছে। আমরা বার বার সংকল্প করি এটা করব না। এটা করা অন্যায়, পাপ। আবার মনে ভাবিÑ আজ করে নিই, কাল থেকে আর করব না। ফের আবার করি। এই করতে-করতে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনি। প্রবৃত্তির হাতের ক্রীড়ানক হয়ে উঠি। শেষে পরজন্মে শিয়াল-কুকুর হয়ে জন্মানো ছাড়া পথ থাকে না।” কি সাংঘাতিক বিভৎস ব্যাপার! কত সাধনায় মানব জন্ম পেয়েছি! প্রসঙ্গক্রমে শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীতে রয়েছেÑ“ যখনই তোমার কুকর্ম্মের জন্য তুমি অনুতপ্ত হবে, তখনই পরমপিতা তোমাকে ক্ষমা করবেন, আর ক্ষমা হলেই বুঝতে পারবে তোমার হৃদয়ে পবিত্র সাত্বনা আসছে, আর তাহলে তুমি বিনীত, শান্ত ও আনন্দিত হবে। যে অনুতপ্ত হয়েও পুনরায় সেই প্রকার দুষ্কর্ম্মে রত হয়, বুঝতে হবে সে সত্বরই অত্যন্ত দুর্গতিতে পতিত হবে। মানুষের কুপ্রবৃত্তি তার নিজের কাছে আগে নিজে সমর্থনে গা ঢাকা দিয়ে থাকে, পরে এৎফাঁক করে নানান ভাঁওতায় মানুষের চোখে ধুলো দিতে থাকে, তাই যদি ভালই চাওÑআগে নিজের কাছে নিজে ধরা পড়, সঙ্গে-সঙ্গে তার সুনিয়ন্ত্রন করতে থাক। তুমি যদি তোমার অবাঞ্ছিত চরিত্রের উপর হস্তক্ষেপ না কর, তাকে যথাবিহিত নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়ভাবে সংস্থ করে না তোল, লাখ শিক্ষিত হও না কেনÑ তোমার স্বাভাবিক উন্নতি তখনও মরীচিকাবৎ।
বৃত্তি-প্রবৃত্তি তাঁরই দানÑকাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি থাকবেইÑএগুলোকে ধফলঁংঃ করতে হবে। তিনি হলেন লঁংঃ, তাঁর সঙ্গে নিজেদেরকে ধফ করলে-ই ধফলঁংঃবফ হওয়া সম্ভব।
ইষ্টের প্রতি টান যত তীব্র
প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ তত শিঘ্র।
২৫ জানুয়ারী-২০১০, আচার্য্যদেব পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদা পার্লারে উপবিষ্ট, এমন সময় পূজনীয় অবীনদা এসে শ্রীশ্রীদাদার কোলে বসলেন। দাদু-নাতীর লীলা মাধুর্য্য অবলোকন করছিলাম ভক্তসকলে মিলে। আমি মনে-মনে নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছিলাম যে, হ্যাঁ এই ছোট্ট ৬/৭ বছরের ছেলেটি একদিন আচার্য্য পদাভিসিক্ত হবেন। একদিন তিনিই হবেন সমগ্র বিশ্ব-সৎসঙ্গের পরিচালক, সকলের ভাগ্য নিয়ন্তা। পূজনীয় বাবাইদা একদিন ঋত্বিক অধিবেশনে বলেছেনÑ‘সেই-ই প্রথম শ্রেনীর কর্মী যে আচার্য্যকে ঠাকুর বলে জানে।’ আমার সাত-প্যাচে ভরা মনটা বার-বার বলছিল পূজনীয় অবীন বাবু কি তাই? তাও কি সম্বব! এতটুকু বাচ্চা ছেলে! এমন সময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। অবীনদা বললেন দাদুকেÑতুমি বেনুদাকে (ড্রাইভার) বলে দাও আমি গাড়িতে ঘুরতে বের হব। শ্রীশ্রীদাদা বললেনÑতুমি বল, তুমিও যা আমিও তাই। আমরা সবাই সমান। অবীনদা আবার বললেনÑ আমি বললে ও গাড়ী আনতে যাবে না, তুমি বললে যাবে। শ্রীশ্রীদাদা বললেনÑবলেই দেখ না, তুমি বললে যা হবে আমি বললেও তাই হবে। অবীনদা বেনুদাকে গাড়ী আনতে বললেন। বেনুদা দৌড়ে গাড়ী আনতে ছুটল। অন্তর্যামী শ্রীশ্রীদাদা অবীন বাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে-করতে আমার অন্তরের প্রশ্নের সমাধান দিলেন কবিতার ভাষায়। আমার অবিশ্বাসী পাপিষ্ট মনের ময়লা দূর হল। শ্রীশ্রীদাদা আবৃত্তি করলেনÑ
আমরা সবাই রাজা
আমাদেরই রাজার রাজত্বে।
নইলে মোদের রাজার সনে
মিলব কি শর্তে।
আমরা যা খুশি তাই করি
তবু তার খুশিতে চলি।
আমরা চলব আপন মতে
তবু মিলব তার সাথে।
রাজা সবারে দেয় মান
সে মান সবই ফিরে পান।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীতে আছেÑ
মানুষেরে প্রীত করে দীপ্তি পান যিনি,
এই দুনিয়ায় তিনিই রাজা তোমার রাজাও তিনি।
ইষ্টে রেখো ভক্তি অটুট শক্তি পাবে বুকে,
তারই কর্মে রাঙাও স্বভাব পড়বে নাকো দুঃখে।
প্রায় বিশ বছর যাবৎ ঠাকুরের এই অভয় বাণী কখনও বলি, কথনও বা শুনি। কিন্তু নির্ভরতা কোথায় যে ফল পাব? ভক্তি, বিশ্বাস সাধন-ভজন কোথায় আমার? শ্রদ্ধেয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য সহপ্রতিঋত্বিক, সিলেট, তাকে আমার ভাল লাগে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে ইষ্টধান্ধায় ব্যয় করে চলেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কেন্দ্র-মন্দিরে তার প্রেরণা, সহযোগীতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। ঠাকুর পরিবারের সকলেই তাকে বড় ভালবাসেন। ২০ বৎসর আগের কথা তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি তার নামও জানি না, তিনিও আমাকে চিনে না। প্রথম দেখাতেই আমাকে অত্যন্ত সিক্রেট একটা ব্যাপারে সতর্ক করলেন। বললেনÑতোমাকে দেখেই আমার এমন মনে হল, সাবধান! কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেল। কি আশ্চার্য! বিশিষ্ট জ্যোতিষী আমার কুষ্টি গণনা করে ঐ একই কথা লিখলেন। অধ্যক্ষ সুনিল বিশ্বাসের বাড়িতে প্রথম যেয়ে তার একমাত্র মেয়ে পাপিয়াকে দেখেই দাদা বললেনÑতোমাকে দেখে আমার মনে হল তোমার শরীরে কিছু দিনের মধ্যেই একটা রোগ আসবে। তুমি রোজ সকালে নারিকেল তেল মেখে পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করবে। সে বললÑও বাবা! আমি পারব না। কিছুদিন পরে জানলাম মেয়েটিকে চিকিৎসার জন্য ৩-বার সিঙ্গাপুর নেওয়া লাগছে। একটা ঘটনা না বললে নয়Ñরামকৃষ্ণদার ডাকে ১৫ জানুয়ারী মদন উৎসবে গিয়েছি। তবে এবার বাড়ি থেকে আমার বের হওয়াটা ছিল ভিন্নরকম। বউকে বললামÑআমার বলতে আর কিছুই নেই, এ-সংসারে যা কিছু সব তোমার আর তোমার সন্তানদের, আমার ছুটি। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। আমি এখন শুন্য, ঠাকুরই আমার ভরসা, চললাম। উৎসব হল, দীক্ষাও হল। তারপর রামকৃষ্ণদার সঙ্গে সিলেট গেলাম। তার মেয়েটাকে দেখে দিলুদাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কি পড়ছে? বললÑমেডিকেল পড়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিল, সরকারীভাবে সুযোগ হয়নি। এখানে প্রাইভেট মেডিকেল পড়তে রাবেয়াতে বহু টাকার ব্যাপার! তাছাড়া টাকা হলেও এ-বছর আর কোন প্রকার সুযোগ নেই। মায়ের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তার মেয়ে মেডিকেল পড়তে না পারায় মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চলেছে, কিন্তু বাহির থেকে কিছুই বোঝার জো নেই। মা ও মেয়ের ১৫ বছরের সাধনার অকালমৃত্যু যা’ তা’ শোক নয়! তবে মেয়ে খোলা মনে বললÑআমি ভেবেছি, এবৎসর দেশের বিভিন্ন চার্মিং স্পটে ঘুরে বেড়াব, আগামী বৎসর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি হব। রামকৃষ্ণদার মেয়ে আইএসসি পাশ করেছেÑআমি জানতাম না। এখানে এসে জানলাম। তাছাড়া ওনার কাছে হাজারও মানুষ রোগ-শোক নিয়ে প্রতিনিয়ত আসে। কিন্তু নিজের সুখ-দুখের কথা ভুলেও কাউকে বলতে শুনি নাই। সর্বক্ষণ তো ইষ্টপ্রসঙ্গে মাতোয়ারা থাকেন। রাত্রে শুয়ে-শুয়ে ভাবছি এতবড় একটা স্বপ্ন ব্যর্থ হতে চলেছে, দাদার অভিমত কি? ফোনে দাদা বললেনÑআমি কোনদিন ঠাকুরের কাছে কিছুই চাইনি। আমার কিসে মঙ্গল তিনিই তা জানেন। হ্যাঁ না যা হোক সব কিছু তাঁর ইচ্ছা, আর এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দাদা তখন পাবনা অবস্থান করছেন, পূজনীয় বিংকিদার নির্দেশে ও আচার্য্যদেবের আশীর্বাদ বাস্তবায়নে রত আছেন। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা আমাকে তাড়া করে ফিরছে। সুবিদ চক্রবর্তীদাকে বললামÑআমাদের খুলনায় একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হয়েছে। যার প্রিন্সিপাল আমাদের গুরুভাই, নাম ডাঃ শৈলেন মিস্ত্রী। সুবিদদা শুনেই বললেনÑতার ছেলে ও মেয়েকে আমি মুখে ভাত দিয়েছিলাম। বললামÑদেখি চেষ্টা করে কি করা যায়। ডাঃ শৈলেনদা রামকৃষ্ণদাকে আগে থেকেই জানতেন। গভীর শ্রদ্ধা করেন তাকে। শৈলেনদা বললেনÑআমাদের কলেজে ভর্তি শেষ হয়ে গেছে, অতিরিক্ত ১০ টি আসনের জন্য বোর্ডে অনুমোদন চেয়েছি। যদি অনুমোদন পাই তবে রামকৃষ্ণদার মেয়ে বিধায় আমার সবরকম চেষ্টা থাকবে। সুবিদদাকেও যথেষ্ট সম্মান দেখালেন শৈলেনদা। অবশেষে ২ দিন পর গ্রীন সিগন্যাল পাওয়া গেল, প্রজ্ঞার স্কোর ১২৪, ভর্তির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলÑ২ দিনের ভিতর ১০ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। নইলে অনেক পয়সাওয়ালা বাপ বেশী পয়সা দিয়ে আসন কিনে নেবে। প্রজ্ঞার মুখে শুনলাম আচার্যদেব বলেছেনÑ‘পরম পিতাকে ডাক।’ হয়তো তার ডাক পরমপিতার দরবারে কবুল হয়েছে। প্রজ্ঞা মেডিকেল কলেজে যথাসময়ে মর্যাদার সাথে ভর্তি হল। মাঝে-মাঝে ভাবি তাঁর দয়ায় কি না সম্ভব!
ইষ্টনিষ্ঠা কৃতিচর্য্যায় বিভবের অভাব কি!
ছাইয়ে ফলে সোনা তাদের জলে গজায় ঘি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেনÑ“মানুষ ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদের পথে যখন চলে, অর্থাৎ তাঁর অনুশাসন পরিপালন করে চলে,Ñতখন তার প্রয়োজনের উপকরণ ভূতে যোগায়। যারা প্রাণে প্রাণে বিশ্বাস করে, প্রাণে প্রাণে ডুবে থাকে তাদের সংসার অচল হয় না। ভগবান মাথায় করে তাদের খাদ্যসামগ্রী এনে থাকে। তাদের পুত্র পৌত্রাদি পর্য্যন্ত সুখে থাকে। যে আমার কাজ করে, তার সাথে আমার আশীর্বাদ ঘোরে। যদি সৎ পরিচালক অবলম্বন করে থাক ভয় নাই, মরবে না; কিন্তু কষ্টের জন্যে রাজী থাক।”
লিখেছেন- অজয় সরকার-( এসপিআর, খুলনা।)
Post a Comment