Ads (728x90)

SRI SRI THAKUR VIDEO

Like this page

Recent Posts

World time

Add as a follower to automatically get updated Article. Jaiguru!



পর পর তিনটি মেয়েসন্তান জন্মাল। বাবার স্বপ্ন ছেলেসন্তান আসুক সংসারে। খানজাহান আলী (রহ.)-এর দরগা শরিফে গেলেন। প্রার্থনা করলেন। চাঁদের টুকরোর মতো ছেলেসন্তান এল। খানজাহান আলী (রহ.)-এর সম্মানে ছেলের নাম রাখলেন খানজাহান। ডাকনাম সম্রাট। যেন বড় হয়ে এই ছেলে তার নামের মতো হয়। জীবনের যে ক্ষেত্রে পা রাখবে, সেখানেই যেন তার পদচারণ হয় সম্রাটের মতো।
হলোও তা-ই। স্কুলে ঢুকেই দুর্দান্ত রেজাল্ট করতে লাগল সম্রাট। বাবার চাকরিসূত্রে খুলনায় বসবাস। সেখানকার সেন্ট যোসেফ স্কুলে ক্লাসের পর ক্লাস ডিঙাল মেধার শীর্ষে উঠে। এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫। খুলনা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসিতেও একই রেজাল্ট, গোল্ডেন জিপিএ ৫। বাবা চাইলেন ছেলে ডাক্তারি পড়ুক, মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করুক। ছেলে চাইল ইঞ্জিনিয়ার হতে। বুয়েটের শিক্ষক হয়ে দেশ এবং মানুষের সেবা করবে। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিল। মেধাতালিকার প্রথম দিকে তার নাম। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলো। মের ২২ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু। আহসানউল্লাহ হলের ১৩৪ রুমে উঠল সম্রাট। বাবা এলেন সঙ্গে। ছেলের যা যা প্রয়োজন কিনে দিলেন। বইখাতা, বেডশিট, টেবিল ফ্যান। মাত্র পাঁচ দিন ক্লাস করার পর...।
সম্রাটের বাবা খন্দকার শাহ আলম, মা শামসুন্নাহার। শাহ আলম খুলনা সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছিলেন। অবসরে যাওয়ার পর গোপালগঞ্জ শহরের ডিসি রোডের বাড়িতে বসবাস করছেন। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নে। গ্রামের নাম 'নিজড়া'।
হলে উঠেই সুন্দর করে রুম গুছিয়েছিল সম্রাট। পড়ার টেবিল, টেবিলের ওপর বাবার কিনে দেওয়া বইখাতা কলম রাবার স্কেল। খাতার পাতা এখনো সাদা, কিছুই লেখা হয়নি। বিছানা পরিপাটি। বিছানার পাশে চেয়ারে রাখা বাবার কিনে দেওয়া টেবিল ফ্যান। যেন গরমে কষ্ট না পায় ছেলে।
২৭ মে বৃহস্পতিবার। সকাল সাড়ে ৭টা। হল থেকে বেরিয়ে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে এসেছে সম্রাট। বড় বোন শাম্মী থাকেন মিরপুর ১০ নম্বরে। বাসের টিকিট কেটে বোনকে ফোন করেছে। আপু, আমি তোমার বাসায় আসছি। আমার জন্য ভুনা খিচুড়ি রেঁধে রাখো।
একমাত্র ছোট ভাইটিকে নিজের চেয়েও ভালোবাসেন বড় বোন। সঙ্গে সঙ্গে রান্না করতে বসে গেছেন। রান্না শেষ করে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা। কখন আসবে ভাই? কখন সামনে বসিয়ে তাকে ভুনা খিচুড়ি খাওয়াবেন?
ভাই আসে না, ভাই আসে না। এল এক পথচারীর ফোন...
মিরপুরের বাসে ওঠার জন্য ইডেন কলেজের ২ নম্বর গেটের ওদিককার বাস কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করছিল সম্রাট। তখন ৮টার মতো বাজে। উইনার পরিবহনের একটি বাস দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায়। পেছাতে গিয়ে সেই বাস ধাক্কা দেয় সম্রাটকে। সম্রাট রাস্তায় পড়ে যায়। বাসটির পেছনের চাকা চলে যায় সম্রাটের মাথার ওপর দিয়ে।
তার পরের ঘটনা বর্ণনা করতে বুক ফেটে যাচ্ছে। পুলিশ এসে সম্রাটকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডিউটি ডাক্তাররা ৮টা ৪০-এর দিকে জানান, সম্রাট নেই। সম্রাটের পকেটে তার আইডি কার্ড ছিল। কার্ডের সূত্র ধরে পুলিশ তার পরিবারকে খবর দেয়। ভাইয়ের জন্য ভুনা খিচুড়ি নিয়ে বসে থাকা বোন ছুটে আসেন হাসপাতালের মর্গে। ভাইয়ের লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
'কালের কণ্ঠ' সম্রাটের ছবি ছেপেছে ফার্স্ট পেইজে। বড়বোন শাম্মীর ছবি ছেপেছে। হাসিমুখের সম্রাট তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। বোন বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। কোনো কাগজে সম্রাটের সহপাঠীরা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। একটি মেয়ে দুহাতে কান চাপা দিয়েছে, সহপাঠীর এমন মৃত্যুর কথা সে শুনতে চায় না। কান্নায় ভেঙে পড়া সহপাঠীকে জড়িয়ে রেখেছে আরেক সহপাঠী। একজন মুখ চেপে কাঁদছে। বুকফাটা কান্নায় একত্রে ভেঙে পড়েছে তিন সহপাঠিনী। সম্রাটের মা বুক চাপড়াচ্ছেন, আমার ছেলে কোথায় চলে গেল? তাকে ছেড়ে আমি থাকব কেমন করে? দুর্ঘটনার ১০ মিনিট আগে বাবাকে ফোন করেছিল সম্রাট। যে ছেলে ১০ মিনিট আগে ফোন করে সেই ছেলে ১০ মিনিট পর চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায়! ছেলের শোকে বাবা গেছেন পাথর হয়ে।
এ রকম ছবি আর কত দেখতে হবে? এ রকম মৃত্যু আর কত দেখতে হবে? এই মৃত্যুর ফাঁদ থেকে কবে মুক্তি পাব আমরা? গত ১০ বছরে সম্রাটের মতো করেই ঝরে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন ছাত্রছাত্রী, আহত হয়েছে অনেক। ২০০৫ সালের ১৮ এপ্রিল শাহবাগ মোড়ে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় শাম্মী আখতার হ্যাপী। সে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তাকে নিয়ে আমি লিখেছিলাম। আমাদের এই সব লেখালেখি কোনো কাজে লাগে বলে মনে হয় না। ঘটনা ঘটলে, ছাত্ররা যখন প্রতিবাদ করতে পথে নামে তখন তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তারপর যেইকে সেই। কয়েক দিন চুপচাপ, তারপর আবার ঘটে একই ঘটনা। আবার বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয় ছাত্রছাত্রীদের জীবন, একেকটি পরিবারের স্বপ্ন। হায়, এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!
এই লেখা কাউকে উপদেশ দেওয়ার জন্য লিখতে বসিনি। কী করলে অবস্থার উন্নতি হবে, কী করলে রক্ষা করা যাবে আমাদের সন্তানদের, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা থাকেন তাঁরা সেসব জানেন। আমরা সাধারণ মানুষরাও জানি। শুধু জেনে কী হবে, যদি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হয়? যদি আজ ঘটনা ঘটল আর কালই আমরা ভুলে গেলাম, তাহলে লাভ কী? বাস-ট্রাকচালকদের কতটা সাবধানে গাড়ি চালানো উচিত, ট্রাফিক ব্যবস্থা কী রকম হওয়া উচিত, ঘাতক ড্রাইভারের সাজা কী হওয়া উচিত_সব উচিত কাজ করলেই অবস্থা বদলাতে পারে। কিন্তু উচিত কাজটা হচ্ছে কোথায়?
সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর সম্রাটের ছবি দেখে আমার বুক হু-হু করে উঠেছে। আমার দুটি মেয়ের একটি বিবিএ শেষ করেছে, ছোটটি ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। কালের কণ্ঠ হাতে পেয়ে সম্রাটের মৃত্যুসংবাদ পড়তে পড়তে তারা দুজনেই চোখ মুছেছে। এ বয়সের একটি ছেলে কেন এভাবে মারা যাবে? বাসের চালক আর হেলপার পালিয়ে গেছে। তারা ধরা পড়ল কি না, তাদের কী শাস্তি হলো, আমরা জানতেও পারব না। কিন্তু যে বাবা তাঁর প্রিয়তম সন্তানটিকে হারালেন, মায়ের বুক খালি হলো, যে বোন খাবার সাজিয়ে ভাইয়ের জন্য বসে থাকবেন, ভাইটি আর কোনোদিনও ফিরবে না_এই মানুষগুলো যা হারাল তা কে তাদের ফিরিয়ে দেবে? মা-বাবা আর তিন বোনের মাঝখানে বসে ছিল যে ছেলেটি, তাকে কেড়ে নিল বাসের চাকা। শুধু সে একা পিষ্ট হলো না, পুরো পরিবার পিষে গেল। দেশ হারাল তার এক মেধাবী সন্তান।
ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছিলেন, তুমি তোমার নিজের জন্য, তোমার পরিবার এবং সমাজের জন্য, তোমার দেশ এবং এই পৃথিবীর ভালো ও মন্দের জন্য দায়ী।
সম্রাটের মৃত্যুর জন্য আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। বাংলাদেশ দায়ী। সম্রাট, তোমার মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়।

Post a Comment